ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়েছে, কিন্তু পতন হয়নি চাঁদাবাজদের। ঢাকাসহ সারাদেশের মাঠে-ঘাটে এখনও প্রবল প্রতিপত্তি নিয়েই সক্রিয় রয়েছে চাঁদাবাজরা। শুধু পার্থক্য একটাই। আগে চাঁদাবাজি হতো আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের ব্যানারে। আর এখন হচ্ছে নিত্য-নতুন ব্যানারে। চাঁদাবাজির এই পালাবদলে ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে খেটে খাওয়া মানুষ আগের মতোই কষ্টে আছেন। বরং কোনো-কোনো সেক্টরে চাঁদার মূল্য বেড়ে যাওয়ায় ভুক্তভোগীদের যন্ত্রণা দ্বিগুণ হয়েছে।
চাঁদাবাজি বন্ধে অন্তর্বর্তী সরকার, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা এবং বিএনপির সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে কঠোরতার ঘোষণা এসেছে দফায়-দফায়। তবে কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না চাঁদাবাজি। যদিও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আরও কঠোর হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন ইতোমধ্যে।
দায়িত্বশীল একটি সূত্রের দাবি, সরকারের উচ্চপর্যায়ের নির্দেশে একটি গোয়েন্দা সংস্থা সারাদেশে চাঁদাবাজদের একটি তালিকা তৈরি করেছে। এই তালিকা ধরে অভিযান চালাতে ইতোমধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এই তালিকাভুক্তদের কে কোন দলের বা কে কোন মতের, তা না দেখতেও সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। শিগগির চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করা হবে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, চাঁদাবাজদের সবচেয়ে বড় টার্গেট পয়েন্ট হচ্ছে শিল্পাঞ্চল, বাণিজ্যিক এলাকা, বাস ও নৌ-টার্মিনাল, বালুমহাল ও হাটবাজার। রাজধানীতে চাঁদাবাজদের সবচেয়ে বড় রাজত্ব সায়েদাবাদ, মহাখালী, গাবতলী আর ফুলবাড়িয়া বাসস্ট্যান্ড বা টার্মিনাল ঘিরে। আগে এসব এলাকার চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করত ‘শাহজাহান-রাঙা, এনায়েত-সিরাজ, কালাম-রুস্তম-সামদানি’ সিন্ডিকেট। তারা সরাসরি আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত ছিলেন। পরিবহন নেতা নামধারী এই চাঁদাবাজরা এখন সবাই পলাতক। কিন্তু তাতেও থেমে নেই চাঁদাবাজি। এখানে এসেছে নতুন মুখ।
জানা গেছে, পরিবহন খাতে চাঁদাবাজিতে পুরোনোর শূন্যস্থানে এখন সক্রিয় রয়েছে সাইফুল-কফিল-বিশ্বাস গ্রুপ। পরিবহন সেক্টর বাদেও মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকা ও তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলেও শুরু হয়েছে নতুন মুখের চাঁদাবাজি।
ইলিয়টগঞ্জ এক্সপ্রেসের মালিক ও পরিবহন নেতা সাইফুল ইসলাম আগের দুই দফায় বিএনপির শাসনামলে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। গত ১৪ আগস্ট সাইফুলের নেতৃত্বে সমিতির ৩১ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটিও ঘোষণা করা হয়।
চাঁদাবাজদের আরেকটি বড় টার্গেট পয়েন্ট রাজধানীর কারওয়ান বাজার। আগে এই এলাকা নিয়ন্ত্রণ করতেন ইরান ও তার অনুগত সন্ত্রাসীরা। সরকার পরিবর্তনের পর তাদের গা-ঢাকা দেওয়ার পর এসেছে আরেক গ্রুপ। দখল ও চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র করে গত ৯ সেপ্টেম্বর রাতে সংঘর্ষ হয় কারওয়ান বাজারে। এক ঘণ্টার বেশি সময় ধরে চলা ওই সংঘর্ষের সময় অনেকের হাতেই দেশীয় অস্ত্র দেখা গেছে। এ ঘটনায় অন্তত ১০ জন আহত হয়। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, তেজগাঁও থানা শ্রমিক দলের জালাল, জাহাঙ্গীর, আনু, জাহিদ, সুমন, হাফিজসহ কয়েকজন ওই রাতে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে জোরপূর্বক চাঁদা আদায় করতে গেলে তারা প্রতিরোধের মুখে পড়লে এই সংঘর্ষ বাঁধে। তবে খবর পেয়ে শিক্ষার্থীরা আসার ফলে ঘটনা বেশি দূর এগোয়নি। অভিযুক্ত জালাল আহমেদকে তেজগাঁও থানা পুলিশের জিম্মায় দিয়ে দেন ব্যবসায়ী ও শিক্ষার্থীরা। কিন্তু প্রভাবশালী মহলের হস্তক্ষেপে পরদিনই মুচলেকা দিয়ে থানা থেকে তাকে নিয়ে আসেন শ্রমিক দলের নেতারা।
এ বিষয়ে তেজগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোবারক হোসেন বলেন, ‘কেউ চাঁদাবাজ হিসেবে চিহ্নিত হলে তাকে কোনোভাবেই ছাড় দেওয়া হবে না। কারওয়ান বাজারের ঘটনায় উভয়পক্ষ সমঝোতা করে মুচলেকা দেওয়ায় আটক জালালকে তাদের জিম্মায় দেওয়া হয়েছে।’
ব্যবসায়ীরা বলছেন, ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর ব্যবসায়ীদের অফিস ও কারখানার ফটকে ফটকে রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা ভিড় করছেন। ঝুট ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিতে তৈরি পোশাক কারখানায় এমন কান্ড বেশি ঘটছে। আবার ব্যবসায়ীদের কাছে ১৫ থেকে ২০ কোটি টাকা চাঁদা চাওয়ার ঘটনাও ঘটছে।
এদিকে, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংস্থার কার্যালয়েও চাঁদাবাজির উড়ো চিঠি ও ফোনকল করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। গত শুক্রবার চারটি মন্দিরের পক্ষ থেকে খুলনার দাকোপ থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়েছে। জিডিতে উল্লেখ করা হয়েছে, তারা উড়ো চিঠি পেয়েছেন। দুর্গাপূজা করতে হলে প্রতিটি মন্দিরের পক্ষ থেকে পাঁচ লাখ টাকা চাঁদা দিতে হবে।
মামলা থেকে নাম বাদ দেওয়ার কথা বলেও চাঁদাবাজি করা হচ্ছে। মামলার আসামির তালিকা থেকে নাম বাদ দিতে স্বেচ্ছাসেবক লীগের এক নেতার কাছে দুই লাখ টাকা চাঁদা দাবির একটি অডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। লক্ষ্মীপুর জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের কৃষিবিষয়ক সম্পাদক জহির উদ্দিনকে মামলা থেকে বাঁচানোর বিনিময়ে টাকা দাবি করেন কৃষকদল নেতা জসিম। পরবর্তী সময়ে লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলা কৃষক দলের নেতা জসিম চৌধুরীকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়।
ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক পরিচয়েও কয়েকটি জায়গায় চাঁদা দাবির অভিযোগ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে গত বুধবার সিলেটের কোম্পানীগঞ্জে সমন্বয়ক পরিচয়ে চাঁদাবাজির চেষ্টাকালে নয়জনকে আটক করে পুলিশের কাছে সোপর্দ করেছে স্থানীয়রা।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের নামে চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে হুঁশিয়ার করে সম্প্রতি আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম বলেন, একটা গোষ্ঠী মিথ্যা মামলা ও চাঁদাবাজির চেষ্টা করছে। এ দুটি সমস্যা খুবই প্রকট। কেউ যদি আমাদের নাম ভাঙিয়ে চাঁদাবাজির চেষ্টা করে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। যদি কোনো সমস্যা হয়, তাহলে যেন অন্তর্বর্তী সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অবহিত করা হয়। তাহলে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ###
আপনার মতামত লিখুন :