ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর, ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
রিজার্ভ, বিনিময়হার ও খেলাপিঋণ নিয়ে উদ্বেগ

শর্ত ছাড়াই ঋণ পাচ্ছে বাংলাদেশ

দৈনিক নতুন সংবাদ | বিশেষ প্রতিনিধি সেপ্টেম্বর ২৯, ২০২৪, ১০:২৯ পিএম শর্ত ছাড়াই ঋণ পাচ্ছে বাংলাদেশ

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ থেকে চলমান ঋণ কর্মসূচির চতুর্থ কিস্তি পেতে নতুন কোনও শর্ত পরিপালন করতে হবে না বাংলাদেশকে। পাশাপাশি নতুন করে চাওয়া ৩শ কোটি ডলার ঋণের বিষয়ে অক্টোবরেই ইতিবাচক সাড়া দিতে পারে এই বহুজাতিক ঋণদাতা সংস্থাটি, এমন ইঙ্গিত মিলেছে বাংলাদেশে সফররত আইএমএফ কর্মকর্তাদের থেকে।

গতকাল রোববার বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে সমাপনী বৈঠকে মিলিত হন সংস্থাটির প্রতিনিধি দল। বৈঠকে বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চিতি বৃদ্ধি, মুদ্রার কার্যকরি বিনিময়হার প্রতিষ্ঠা ও খেলাপি ঋণ কমানোর লক্ষ্যমাত্র অর্জন না হওয়ায় উদ্বেগ জানিয়েছেন তারা। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য মিলেছে। 

জানা গেছে, আজ সোমববার গভর্নরের সঙ্গে সমাপনী বৈঠক হওয়ার কথা ছিল আইএমএফ প্রতিনিধিদের। তবে গভর্নর চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে অবস্থান করায় গতকাল রোববারেই ডেপুটি গভর্নর এবং সংশ্লিষ্ট নির্বাহী পরিচালকদের সঙ্গে চূড়ান্ত বৈঠক করেন প্রতিনিধি দলের সদস্যরা। সোমবারে অর্থমন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমাপনী বৈঠকের মাধ্যমে চলতি বাংলাদেশ সফর শেষ করবে গত ২৩ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশে আসা প্রতিনিধি দলটি। 

কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, আইএমএফ মিশনের সঙ্গে চূড়ান্ত বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে নতুন কোনও প্রস্তাব দেওয়া হয়নি। তবে চলমান ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ কর্মসূচির সঙ্গে আরো ৩ বিলিয়নের একটি প্রস্তাব রয়েছে। যা সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে চূড়ান্ত করা হবে। তবে আইএমএফের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে- অক্টোবরে বিশ্ব ব্যাংকের বৈঠকে গভর্নর যোগদানের পর অন্য দাতাগোষ্ঠী থেকে পাওয়া ঋণ হিসাব করে ব্যালেন্স অব পেমেন্টে কি পরিমাণ ঘাটতি থাকে তা নির্ণয় করা হবে। এর ভিত্তিতে ৩ বিলিয়নের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হবে। 

জানা গেছে, সংস্থাটির পক্ষ থেকে নতুন করে কোনও বড় ধরনের সংস্কার প্রস্তাব দেওয়া হয়নি। একই সঙ্গে বাংলাদেশের চলমান সংকোচনমূলক মুদ্রানীতিকে আইএমএফ সাধুবাদ জানিয়েছে। তবে খেলাপি ঋণের বিষয়ে সতর্ক করেছে এবং দ্রুততম সময় তা কমিয়ে আনার তাগিদ দিয়েছে।

ঋণ কর্মসূচির শর্ত অনুযায়ী আর্থিক খাতে সার্বিক খেলাপি ঋণ ৮ শতাংশ, সরকারি ব্যাংকগুলোতে ১০ শতাংশ এবং বেসরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য ঠিক করা আছে। তবে বর্তমানে খেলাপির ঋণ রয়েছে সাড়ে ১২ শতাংশের বেশি। 

অপরদিকে ব্যালেন্স অব পেমেন্টের সার্বিক প্রবৃদ্ধির বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে ঐকমত্য হয়েছে আইএমএফ। সেক্ষেত্রে ২০২৫ সালের মধ্যে রপ্তানিতে ৫ শতাংশ আমদানিতে ৭ শতাংশ এবং রেমিট্যান্সে ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হবে। 

আইএমএফ বলেছে, তারা রিজার্ভের উন্নতি দেখতে চায়। ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে নিট রিজার্ভ ২৪ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করতে হবে। বর্তমানে প্রতি প্রান্তিকেই এটি ২০ বিলিয়নের নিচে অবস্থান করছে। তাই রিজার্ভ বৃদ্ধির লক্ষ্যে কার্যকর পরিকল্পনা গ্রহণের জন্য তাগিদ দিয়েছে সংস্থাটি। বর্তমানে নতুন করে কোনও টার্গেট নির্ধারণ না করলেও নিট রিজার্ভ কমে যাওয়ার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে মিশন সদস্যরা। আইএমএফের  হিসাবে বর্তমানে নিট রিজার্ভ রয়েছে মাত্র সাড়ে ১২ বিলিয়ন ডলার। 

জানা গেছে, বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হারের বিষয়ে জোর আপত্তি জানিয়েছে আইএমএফ। সংস্থাটি বলছে, বর্তমানে যে ‘ক্রলিংপেগ’ ব্যবস্থা চালু রয়েছে তা বাজারভিত্তিক বিনিময় ব্যবস্থাপনা নয়। এর মাধ্যমে পরোক্ষভাবে বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। তাই বিনিময় হারকে পুরোপুরি বাজারভিত্তিক করার তাগিদ দিয়েছে প্রতিনিধি দল। 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র হুসনে আরা শিখা বলেন, ‘আইএমএফ নতুন কোন শর্ত আরোপ করেনি। বিনিময়হার আরও বাজারভিত্তিক করা, রিজার্ভের আরও উন্নতি এবং খেলাপিঋণ কমিয়ে আনার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে আইএমএফ প্রতিনিধিরা। আমরা মনে করি, বর্তমানে বিনিময়হার স্থিতিশীল আছে। তাই আরও বাজারভিত্তিক করা বলতে আইএমএফ যা বলছে সে সম্পর্কে আমরা একমত নই। 

আর খেলাপিঋণ কমানোর বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক সাম্প্রতিক সময়ে যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে সেটি বাস্তবায়ন হলে এমনিতেই অনেক কমে যাবে। আমরা যেভাবে প্রতিটি ব্যাংকের সম্পদের মান যাচাই করছি এবং সম্পদ পুনরুদ্ধারের উদ্যোগ নিয়েছি সেটি বাস্তবায়ন হলে খেলাপিঋণ অনেকটাই কমে আসবে। আইএমএফ বিষয়টি বুঝতে পেরেছে তাই এই বিষয়ে তারা তেমন কোনও আপত্তি জানায়নি। 

তিনি বলেন, সব মিলিয়ে আমাদের যেসব ঘাটতি রয়েছে তার সংস্কার কার্যক্রম চলমান আছে। বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে আগামী কিস্তি ছাড় করতে অনুরোধ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। 

এদিকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আজ সমাপনী বৈঠকে বসবে আইএমএফ প্রতিনিধি দল। সরকারের বর্তমান রাজস্ব আয় এবং ব্যয় ব্যবস্থাপনার বিষয়ে সংস্কারের পরামর্শ রয়েছে সংস্থাটির। সেক্ষেত্রে বন্যার কারণে আয় কমে যাওয়া এবং ব্যয় সংকোচনসহ সার্বিক বিষয়ে পরিকল্পনা জানতে চেয়েছে আইএমএফ। 


সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, বাংলাদেশের রাজস্ব আদায় পরিস্থিতি নিয়ে সন্তুষ্ট নয় আইএমএফ। রাজস্ব আদায় কেন কম হচ্ছে, তা জানতে চেয়েছেন সংস্থাটির প্রতিনিধিরা। এ ছাড়া এখন পর্যন্ত কত টাকা করছাড় দেওয়া হয়েছে, সেটিও তাঁরা জানতে চেয়েছেন।

এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ে সাড়ে ২৭ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি হয়েছে। কেন এত বড় ঘাটতি হলো, তা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে আইএমএফ। তারা এনবিআরকে রাজস্ব আদায়ের নতুন পরিকল্পনা তৈরির পরামর্শ দিয়েছে। এ অবস্থায় এনবিআর কর্মকর্তারা দেশের সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক অবস্থা ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার উল্লেখ করে আইএমএফ প্রতিনিধিদলকে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য কমানোর অনুরোধ জানান।

এদিকে, গত কয়েক বছরে কত শুল্ক-কর ছাড় দেওয়া হয়েছে, তা জানতে চেয়েছে আইএমএফ। এই করছাড় যৌক্তিক হারে কমানোর সুপারিশ করেছে আইএমএফের সফররত প্রতিনিধিদলটি। এনবিআরের শুল্ক বিভাগের হিসাব অনুযাযী, গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে সব মিলিয়ে প্রায় ৩৪ হাজার কোটি টাকার শুল্ক ছাড় দেওয়া হয়েছে। আয়কর বিভাগও আলাদা হিসাব করেছে। তারা জানায়, ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে ১ লাখ ২৫ হাজার ৮১৩ কোটি টাকার আয়কর ছাড় দেওয়া হয়। এর মধ্যে প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে তথা করপোরেট করে ৮৫ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা বা ৬৮ শতাংশ এবং ব্যক্তিপর্যায়ের করদাতাদের ক্ষেত্রে সাড়ে ৪০ হাজার কোটি টাকা ছাড় দেওয়া হয়।

এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা বা অটোমেশন ব্যবস্থা জোরদার করার জন্য আইএমএফ তাগিদ দিয়েছে। এ ব্যাপারে সহায়তা করবে সংস্থাটি। রাজস্ব খাত সংস্কারের স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি একটি কৌশলপত্র দেখতে চায় আইএমএফ। এ জন্য পরিকল্পনা প্রণয়নে সংস্থাটি সহায়তা করবে বলে জানায়।


বর্তমানে আইএমএফের সঙ্গে ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলারের একটি ঋণ কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ। ইতিমধ্যে তিন কিস্তির অর্থ ছাড় হয়েছে। এর বাইরে নতুন করে ৩০০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ বাড়তি ঋণ নিয়েও এখন আলোচনা চলছে। অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ব্যাংক খাত সংস্কারের পাশাপাশি মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ, কর ব্যবস্থাপনা, আয়কর ও ভ্যাট সংস্কারের জন্য কারিগরি সহায়তা চাওয়া হয়েছে আইএমএফের কাছে।

এদিকে, বাংলাদেশে বাজেটের আকারের তুলনায় ভর্তুকির পরিমাণ বেশি বলে মনে করছে আইএমএফ। বহুজাতিক সংস্থাটি বলেছে, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও সারে ভর্তুকি কমানোর সুযোগ রয়েছে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দ করা হয় ১ লাখ ১২ হাজার কোটি টাকা। আইএমএফ চায়, এ ভর্তুকি কমিয়ে ভবিষ্যতে একটা যৌক্তিক জায়গায় নিয়ে আসুক সরকার। সে জন্য কৌশল প্রণয়নের পাশাপাশি নীতি-পদক্ষেপ হাতে নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে সংস্থাটি।


যথাযথ ভর্তুকি ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি সামাজিক নিরাপত্তা খাতের বরাদ্দ প্রকৃত উপকারভোগীদের কাছে পৌঁছানোর বিষয়ে ইতোমধ্যে আলোচনা হয়। আইএমএফের প্রতিনিধিদলটি বাংলাদেশের কাছে জানতে চেয়েছে, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও সারের ভর্তুকি বাবদ বকেয়া পরিস্থিতি কী এবং সেসব বকেয়া পরিশোধের পরিকল্পনাই-বা কী সরকারের।

চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ করা হয় ১ লাখ ৩৬ হাজার ২৬ কোটি টাকা, যা আগের অর্থবছরে ছিল ১ লাখ ২৬ হাজার ২২৭ কোটি টাকা। মুক্তিযোদ্ধা ভাতা, মাতৃত্বকালীন ভাতা, বয়স্ক ভাতা, বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা ভাতা, অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর ভাতাসহ বিভিন্ন খাতে এ টাকা ব্যবহার করা হয়। যদিও কিছু ক্ষেত্রে উপকারভোগীদের তালিকা তৈরি ও বাছাই প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, আইএমএফের প্রতিনিধিদল সামাজিক নিরাপত্তা খাতের সম্প্রসারণ চায়।
 

Side banner