অব্যাহত রয়েছে বিগত সরকারের নেওয়া আট মেগা প্রকল্প। তবে, রাজনৈতিক বিবেচনায় নেয়া একটি মেগা প্রকল্পের আংশিক বাদ দিচ্ছে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পতন হওয়া আওয়ামী লীগ সরকার সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিল তাদের নেওয়া ফাস্ট ট্র্যাকভুক্ত আটটি মেগা উন্নয়ন প্রকল্প। এ সব প্রকল্প বাস্তবায়নেই ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ১৩ হাজার ৫২০ কোটি টাকা। এগুলোর মধ্যে পদ্মা সেতুর কাজ শেষ হলেও বাকিগুলো এখনো চলমান। যদিও অন্যান্য প্রকল্পগুলোর কাজ এগিয়েছে অনেক দূর। তবে এই আটটির ভেতর থেকে একটির আংশিক বাদ দিচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। কিন্তু বাকি প্রকল্পগুলো দ্রুত শেষ করতে চায় তারা। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় ও পরিকল্পনা কমিশনের একাধিক সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
রাজনৈতিক প্রকল্প বাদ দেওয়া প্রসঙ্গে পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ এর আগে বলেছিলেন, ‘আমরা কোনো প্রকল্পই বন্ধ করার প¶ে নই। তবে যেসব প্রকল্প রাজনৈতিক বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে এবং বাস্তবায়নও প্রায় শেষ পর্যায়ে সেগুলোর বিষয়েতো কিছু করার নেই। আমি পরিকল্পনা কমিশনের সেক্টরগুলোতে নির্দেশনা দিয়েছি অপ্রয়োজনীয় এবং রাজনৈতিক বিবেচনায় নেওয়া নতুন কোনো প্রকল্প যাতে না নেওয়া হয়। এ বিষয়ে তারাই সিদ্ধান্ত নেবে। আমার কাছে কোনো তালিকা নিয়ে আসার দরকার নেই। মেগা প্রকল্পগুলোর কাজ অনেক দূর এগিয়েছে। এরপরও পর্যালোচনার সুযোগ আছে। কিন্তু একেবারেই বন্ধ করার বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত সরকারের নেই।’
সূত্র জানায়, আটটি প্রকল্পের মধ্যে এরইমধ্যে পদ্মা সেতুর কাজ শেষ হয়েছে। চলমান আছে মেট্রোরেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, রামপাল মৈত্রী বিদ্যুৎ প্রকল্প, মহেশখালী-মাতারবাড়ী সমন্বিত অবকাঠামো উন্নয়ন, পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর, পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ এবং দোহাজারী-রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু-মিয়ানমারের নিকটে ঘুমধুম পর্যন্ত সিংগেল লাইন ডুয়েলগেজ ট্র্যাক নির্মাণ প্রকল্প। এসব বাস্তবায়নে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ১৩ হাজার ৫২০ কোটি টাকা। এর মধ্যে বৈদেশিক ঋণ রয়েছে ২ লাখ ৮ হাজার ৭৮২ কোটি টাকা। শুরু থেকে গত জুলাই মাস পর্যন্ত প্রকল্পগুলোর আওতায় ব্যয় হয়েছে ২ লাখ ৩৬ হাজার ৪৮৮ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। এ¶েত্রে গড় আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে ৭৮ দশমিক ৮২ শতাংশ এবং ভৌত অগ্রগতি ৯১ দশমিক ৫৪ শতাংশ।
তবে এরই মধ্যে ¶মতাচ্যুত আওয়ামী সরকারের ফাস্ট ট্র্যাকভুক্ত মেগা প্রকল্পগুলোর মধ্যেও কম গুরুত্বের একটি প্রকল্প চিহ্নিত করা হয়েছে। রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রকল্প নেওয়ায় এখন সেটি গলার কাটায় পরিণত হয়েছে। ফলে নতুন করে মূল্যায়ন করা হয়েছে। এতে ‘দোহাজারী হতে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু হতে মায়নমারের নিকটে গুনদুম পর্যন্ত সিংগেল লাইন ডুয়েলগেজ ট্র্যাক নির্মাণ’ প্রকল্প থেকে বাদ যাচ্ছে ‘রামু হতে গুনদুম পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণ’ কাজ। ফলে বেঁচে যাচ্ছে প্রায় ৬ হাজার ৬৮২ কোটি টাকা। এ জন্য প্রকল্পটির দ্বিতীয় সংশোধনী প্রস্তাব নিয়ে সম্প্রতি পিইসি সভা করেছে পরিকল্পনা কমিশন।
প্রল্পটির বিষয়ে সম্প্রতি পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, ‘কক্সবাজার গুনদুম প্রকল্পটি হাতে নেওয়া আগে গভীরভাবে চিন্তা করা হয়নি। তখন বলা হয়েছিল, এটি বাস্তবায়িত হলে ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ের সঙ্গে যুক্ত হওয়া যাবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো- গুনদুমের ওপারে মিয়ানমারে শুধু পাহাড়ি এলাকা। সেখানে রেললাইন তৈরির কোনো পরিকল্পনাও নেই দেশটির। তাহলে এত টাকা ব্যয়ে অপরিকল্পিত প্রকল্প নেওয়ার কী প্রয়োজন ছিল।’
পরিকল্পনা কমিশনের দায়িত্বশীল একার্ধিক কর্মকর্তা জানান, প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ঋণ দিচ্ছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। তবে রামু-গুনদুম অংশের জন্য অর্থায়ন করতে অপারগতা প্রকাশ করেছে সংস্থাটি। এ ছাড়া, মিয়ানমারের যে সংঘাতময় অস্থির পরিস্থিতি চলছে সেখানে ট্রান্স এশিয়ান রেলসংযোগ স্থাপন আপাতত সম্ভব নয়। এজন্য সরকারের নিজস্ব তহবিলের বিপুল অর্থ ব্যয় করে গুনদুম পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণ করাটা যৌক্তিক হবে না। এটা বাস্তবতার পরিপ্রে¶িতে বাদ দেওয়া হচ্ছে।
বাস্তবায়ন পরিবী¶ণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন বলেন, ‘মেগা প্রকল্পগুলোর বিষয়ে এখনো কোন নির্দেশনা আমরা পাইনি। তবে যেসব প্রকল্পের কাজ শেষের পথে সেগুলো বন্ধ করা হবে না বলেই আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি। কেননা, এগুলোর পেছনে এরই মধ্যে অনেক টাকা খরচ হয়ে গেছে।’
মেগা প্রকল্পগুলোর বর্তমান অবস্থা
পদ্মা সেতু: ২০২৩ সালের ২৫ জুন উদ্বাধন করা হয় পদ্মা সেতু। প্রকল্পের বাস্তব অগ্রগতি শতভাগ। গত জুলাই পর্যন্ত প্রকল্পটির আওতায় ব্যয় হয়েছে ৩০ হাজার ৭৭০ কোটি ১৪ লাখ টাকা। আর্থিক অগ্রগতি দাঁড়িয়েছে ৯৪ দশমিক ৩৭ শতাংশ। এটি বাস্তবায়নে ৩২ হাজার ৬০৫ কোটি ৫২ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। প্রকল্পটির কার্যক্রম শুরু হয় ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে। এর পর কয়েক দফা মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প: শুরু থেকে ২০২৪ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত ভৌত অগ্রগতি দাঁড়িয়েছে ৬৯ দশমিক ০১ শতাংশ। প্রকল্পের আওতায় এখন পর্যন্ত খরচ হয়েছে ৭৪ হাজার ৯৮১ কোটি ২ লাখ টাকা। এ¶েত্রে আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে ৬৬ দশমিক ৩০ শতাংশ। এটি বাস্তবায়নে ব্যয় হচ্ছে এক লাখ ১৩ হাজার ৯২ কোটি ৯১ লাখ টাকা। এর মধ্যে রাশিয়ার ঋণ ৯১ হাজার ৪০ কাটি টাকা। ২০১৬ সালের জুলাই থেকে ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে এটি বাস্তবায়নের ল¶্য রয়েছে।
মেট্রোরেল: মেট্রোরেল লাইন-৬ প্রকল্পের উত্তরা-আগারগাঁও অংশ ২০২৩ সালের ২৮ ডিসেম্বর উদ্বোধন করা হয়। ২৯ ডিসেম্বর থেকে নির্ধারিত সময়ে জনগণের চলাচলের জন্য খুলে যায় এ অংশটি। পরবর্তী সময়ে মতিঝিল পর্যন্ত খুলে দেওয়া হয়। এখন নিয়মিত উত্তরা-মতিঝিল ট্রেন চলাচল করছে। তবে কমলাপুর পর্যন্ত পুরো প্রকল্প শেষ হতে সময় লাগবে ২০২৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। প্রকল্পটির আওতায় জুলাই পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ২৪ হাজার ৭১৬ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে ৭৩ দশমিক ৮৪ শতাংশ এবং ভৌত অগ্রগতি ৯০ শতাংশ। এটি বাস্তবায়নে সংশোধিত ব্যয়সহ মোট ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৩৩ হাজার ৪৭১ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। এর মধ্যে বৈদেশিক ঋণ ১৯ হাজার ৭১৮ কোটি টাকা।
পদ্মা সেতুতে রেলসংযোগ: এই প্রকল্পে গত জুলাই পর্যন্ত খরচ হয়েছে ৩৩ হাজার ৪৬৯ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। আর্থিক অগ্রগতি ৮৫ দশমিক ২৮ শতাংশ। এ ছাড়া ভৌত অগ্রগতি হয়েছে ৯৫ শতাংশ। এটি বাস্তবায়নে ব্যয় হবে মোট ৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে বৈদেশিক ঋণ ২১ হাজার ৩৬ কোটি টাকা। প্রকল্পটি ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের জুনের মধ্যে বাস্তবায়নের ল¶্য ছিল।
রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প: এটি বাস্তবায়নে ব্যয় হচ্ছে ১৬ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে বৈদেশিক ঋণ ১৪ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। গত জুলাই পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ১৫ হাজার ২৩২ কোটি টাকা, আর্থিক অগ্রগতি দাঁড়িয়েছে ৯৫ দশমিক ২০ শতাংশ। ভৌত অগ্রগতি হয়েছে ৯৯ দশমিক ১৭ শতাংশ।
পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর: প্রকল্পটি ৪ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়িত হচ্ছে। জুলাই পর্যন্ত খরচ হয়েছে তিন হাজার ৮০৩ কোটি ৮৩ লাখ টাকা, আর্থিক অগ্রগতি ৮৬ দশমিক ৯৬ শতাংশ। প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি দাঁড়িয়েছে ৯২ দশমিক ৮২ শতাংশ।
দোহাজারী-কক্সবাজার-ঘুমধুম রেলপথ: দোহাজারী-রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু-মিয়ানমারের কাছে ঘুমধুম পর্যন্ত সিংগেল লাইন ডুয়েলগেজ ট্র্যাক নির্মাণ প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ব্যয় হচ্ছে ১৮ হাজার ৩৪ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। গত জুলাই পর্যন্ত খরচ হয়েছে ১০ হাজার ৫০ কোটি ৫২ লাখ টাকা। প্রকল্পটির আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে ৫০ দশমিক ১৮ শতাংশ। এ ছাড়া ভৌত অগ্রগতি হয়েছে ৯৮ দশমিক ১৬ শতাংশ।
মহেশখালী-মাতারবাড়ি সমন্বিত কার্যক্রম: মহেশখালী-মাতারবাড়ি সমন্বিত অবকাঠামো উন্নয়ন কার্যক্রম (১২টি প্রকল্পযুক্ত) প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছে ৫৬ হাজার ৬৯৩ কোটি ৯০ লাখ টাকা। এর মধ্যে বৈদেশিক ঋণ রয়েছে প্রায় ৪৯ হাজার কোটি টাকা। ২০১৪ সালের জুলাই থেকে ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে বাস্তবায়নের ল¶্য রয়েছে। জুলাই পর্যন্ত খরচ হয়েছে ৪৪ হাজার ৪৬৪ কোটি ৯১ লাখ টাকা। আর্থিক অগ্রগতি ৭৮ দশমিক ৪৩ শতাংশ এবং সার্বিক অগ্রগতি দাঁড়িয়েছে ৮৮ দশমিক ২০ শতাংশ।
আপনার মতামত লিখুন :