মেয়েটির বয়সই বা আর কত হবে, বড়জোর হলে ১২ই হবে। এই বয়সের শিশুদের বাবা-মা’র আঁচলে মুখ লুকিয়ে কানামাছি খেলার কথা। কিন্তু আজ থেকে চার বছর আগেই শিশু এই মেয়েটিকে দরিদ্র নানি একটু ভালো রাখার জন্য কাজে দেয় সমাজের শিক্ষা-দীক্ষায়, অর্থে-বিত্তে ও প্রাচুর্যেভরা এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে। যেই পরিবারের কর্তা দক্ষিণ বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন।
কিন্তু ভিক্টোরিয়া কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ও তার পরিবার শিক্ষা ও প্রাচুর্যে বড় হলেও মানবিক মানুষ হয়ে উঠতে পারে ননি। আর পারেনি বলেই তার বাড়িতে আশ্রয়িত গৃহপারিচারিকা সুমাইয়া আক্তারকে কাজ করতে গিয়ে পান থেকে চুন খসলেই বেধড়ক পেটাতেন।
পিটিয়েই ক্ষান্ত থাকতেন না অধ্যক্ষ মহোদয়ের স্ত্রী ও তাদের মেয়ে। উনুনে পানি গরম করে সেই গরম পানি শিশু সুমাইয়ার গায়ে নির্দয়, অমানুষের মতো ঢেলে দিয়ে পুুলকিতবোধ করতেন তারা।
বলেছিলাম, কুমিল্লা নগরীর ধর্মপুর এলাকায় সুমাইয়া আক্তার নামের এক গৃহপরিচারিকাকে মারধর করে গায়ে গরম পানি দিয়ে ঝলসে দেয়ার কথা। যিনি এই অসহায়, অবহেলিত ও দরিদ্র শিশু সুমাইয়াকে ঝলসে দিয়েছেন, তিনি হলেন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ আবু তাহেরের স্ত্রী তাহমিনা তুহিন।
এর আগে একইভাবে নির্মম নির্যাতন করতেন তার মেয়ে ফাহমিদা তিমু। গত ৪ জানুয়ারি মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ৭ টায় কুমিল্লা নগরীর ধর্মপুর ভিক্টোরিয়া কলেজ সংলগ্ন পূর্ব দৌলতপুর এলাকার এসআরটি প্যালেস নামক অধ্যক্ষের বাসায় এ ঘটনা ঘটে।
দৈনিক আমাদের কুমিল্লা ও অনলাইন নিউজ পোর্টাল কুমিল্লার জমিন এ গৃহপারিচারিকা সুমাইয়ার বরাত দিয়ে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, ভিক্টোরিয়া কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ আবু তাহেরের মেয়ে ফাহমিদা তিমুর ঢাকার বাসা ও আবু তাহেরের কুমিল্লার বাসায় চার বছর ধরে কাজ করে আসছে সে। কাজে দেরি হলে অধ্যক্ষ তাহেরের স্ত্রী ও মেয়ে ফাহমিদা তাহের তিমু জালি বেত দিয়ে মারধর করে এবং গায়ে গরম পানি ঢেলে দেয়।
২ জানুয়ারি সোমবার গরম পানি ঢেলে পা ঝলসে দেয়। মঙ্গলবার মারধর করার পর গরম পানি ঢালতে চাইলে আত্মরক্ষার্থে বাসার দোতলা থেকে লাফিয়ে পড়ে অসহায় সুমাইয়া। আতঙ্কিত শিশুটি পাশের মেয়েদের হোস্টেলে গিয়ে আশ্রয় নেন।
পরে সুমাইয়াকে আশ্রয় দেওয়া শিক্ষার্থীরা ৯৯৯-এ কল করলে পুলিশ দ্রুত এসে দগ্ধ ও আহত ওই শিশু গৃহপরিচারিকাকে উদ্ধার করে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে নিয়ে যায়। সুমাইয়ার বাড়ি জেলার দেবিদ্বার উপজেলার তেবাড়িয়া গ্রামে।
গ্রেফতারকৃত শিশু নির্যাতনকারী তাহমিনা তুহিন ৯ জানুয়ারি সোমবার আদালতে জামিন আবেদন করলে আদালত জামিন নামঞ্জুর করে পুনরায় তাকে কারাগারে প্রেরণের নির্দেশ দেন।
কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের মতো একটি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষের স্ত্রী ও মেয়ের হাতে মাত্র বার বছরের একটি কন্যা শিশু নির্দয় নিপীড়নের শিকার হবে, এই সভ্য সমাজে এটা কী ভাবা যায়! কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে আমাদের এই সভ্য নামধারী সমাজে তা হচ্ছে হ-র-হা-মে-শা-ই।
আমি যতটুকু জানি অধ্যক্ষ আবু তাহের সাহেবের স্ত্রী ও মেয়ে দুইজনই উচ্চ শিক্ষিত। গৃহপারিচারিকা সুমাইয়ার শরীরের ক্ষত স্থানগুলো দেখলেই তাদের সার্টিফিকেটধারী উচ্চ শিক্ষিত বলা গেলেও প্রকৃতপক্ষে তাদের বলতে হবে জ্ঞান পাপী এবং তারা মা মেয়ে উভয়ই কু-শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছেন।
বর্তমান এই সভ্য সমাজে তাদের আত্মমর্যাদার সাথে টিকে থাকার কোন অধিকার নেই। তাদেরকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। যাতে এমনটি আর দ্বিতীয়বার করতেও যে কেও হাজারবার চিন্তা করে।
যাতে আমাদের সমাজের এমন শিক্ষিত নামধারী এমন পরিবারগুলো আর কোন সুমাইয়াকে গরম পানি ঢেলে দিয়ে ঝলসে দিতে না পারে। কি অপরাধ করেছিল শিশু সুমাইয়া?
হয়তো দারিদ্রতার কষাঘাতে নিস্পেষিত হয়ে চারটা ভাত আর এক টুকরো কাপড়ের জন্য নানি তাকে বাসার কাজের মেয়ে হিসেবে অধ্যক্ষ সাহেবের বাসায় পাঠিয়েছিল।
অধ্যক্ষ আবু তাহের সাহেব ওই দিন কুমিল্লা কোতয়ালি থানায় গণমাধ্যমের কর্মীদের বলেছিলেন, তিনি ওই দিন বাসায় ছিলেন না, তিনি জানতেন না। অথচ গৃহকর্মী সুমাইয়া বলেছেন, চার বছর ধরে সে অধ্যক্ষের ও তার মেয়ের বাসায় কাজ করে আসছে এবং সামান্য ভুল হলেই তাকে সব সময় নির্যাতন করা হতো।
কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ আবু তাহের সাহেব, কলেজ অধ্যক্ষ থাকাকালীন সংবাদ মাধ্যমে আসা আপনার নানা কাহিনিগুলো কিন্তু পাঠকরা ভুলতে বসেছিল।
কিন্তু আপনার স্ত্রীর কল্যাণে আবার আপনি শিরোনাম হয়ে আসছেন। জাতির মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে এসব আপনার সাথে যায় না স্যার, যায় না আপনার পরিবারের সাথেও।
আপনার শিক্ষিত পরিবারের শিশু নির্যাতনের কাহিনি কিন্তু সমাজে ভালো বার্তা হিসেবে পৌঁছায় না। এর সুদূরপ্রসারি কালো প্রভাব পড়তে পারে সমাজে। একবার কি আপনি ভেবে দেখেছেন স্যার, সমাজের অপেক্ষাকৃত কম শিক্ষিত মানুষগুলো যদি মনে করে ভিক্টোরিয়া কলেজের অধ্যক্ষ স্যারের বউ তো কাজের মেয়েকে গরম পানি ঢেলে দেয়, তো আমরাও দেই। এই নেতিবাচক উদাহরণ ও কালো প্রভাব থেকে আমরা মুক্ত হতে চাই।
আমার পছন্দ না হলে আমি তাকে বিদায় করে দিব। কিন্তু কোন গৃহপারিচারিকার গায়ে হাত তোলার নৈতিক এবং ধর্মীয় অনুশাসনের দিক থেকেও কোন অধিকার আমার-আপনার নেই। মহান আল্লাহ আমাদের সবার মধ্যে মানবিক বিবেক জাগ্রত করুক, এই কামনা করি।
লেখক : সাংবাদিক, সংগঠক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখক।
আপনার মতামত লিখুন :