বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন গভীর সংকটের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। অসহনীয় মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্ষয়, ডলার সংকট, ব্যাংকিং খাতে খেলাপিঋণ পুরো অর্থনীতিকে সংকটে ফেলেছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ।
গণঅভ্যুথানের মধ্যে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। ১৮ লাখ ৩৫ হাজার কোটি দেশি-বিদেশি ঋণ রেখে শেখ হাসিনা (সরকার প্রধান) ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় দেশে দৃশ্যমান অবকাঠামোমূলক উন্নয়ন হয়েছে। জাতীয় বাজেটের আকার বাড়িয়ে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) মাধ্যমে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়। আর মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয় সরাসরি বিদেশি ঋণের মাধ্যমে। বাধ্য হয়ে বহুজাতিক এবং দ্বিপক্ষীয় উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে ঋণ নিতে হয়। কারণ, বাংলাদেশ এখনো কাঙ্ক্ষিতহারে রাজস্ব আয় বাড়াতে পারেনি। কর-জিডিপি অনুপাতের দিক থেকে বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান তলানিতে। বর্তমানে কর-জিডিপি অনুপাত ৭ দশমিক ৬ শতাংশ।
বাংলাদেশে রাজস্ব আয় কাঠামো, রাজস্ব প্রশাসন বহুল সমালোচিত। এত কম কর-জিডিপি অনুপাত থাকা সত্ত্বেও প্রতি অর্থবছরে শুল্ক ছাড় দেওয়া হচ্ছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে শুল্ক ছাড় দেওয়া হয় ৩৩ হাজার কোটি টাকা, ২০২১-২২ এ ছাড় দেওয়া হয় ২৮ হাজার কোটি টাকা। বলা প্রয়োজন যে, মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে হলে সর্বনিম্ন ১০ শতাংশ কর-জিডিপি অনুপাত থাকতে হবে।
কর-জিডিপি অনুপাত না বাড়ার কারণে ঘাটতি বাজেট অর্থায়নের জন্য সরকারকে দেশি এবং বিদেশি উৎস থেকে ঋণ নিতে হচ্ছে। বিগত কয়েক বছর ধরে বাজেট ঘাটতি বেড়েই চলছে। অপ্রয়োজনীয় এবং রাজনৈতিক প্রকল্প হাতে নেওয়ার কারণে বাজেট ঘাটতি প্রকট হচ্ছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ৬ শতাংশ, ২০২১-২২ এ ছিল ৬ দশমিক ২ শতাংশ, ২০২০-২১ এ ছিল ৬.০ শতাংশ।
কাঙ্ক্ষিত পরিমাণে রাজস্ব আয় না হওয়ায় দেশি এবং বিদেশি উৎস থেকে বাজেট সহায়তা চাওয়া হয়। বাজেট সহায়তা হিসেবে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে বাংলাদেশ ২০২২-২৩ অর্থবছরে পেয়েছে ১ দশমিক ৭৬৯ বিলিয়ন ডলার, ২০২১-২২ এ ২ দশমিক ৫৯৭ বিলিয়ন ডলার, ২০২০-২১ এ ১ দশমিক ০৯ বিলিয়ন ডলার, ২০২৯-২০ এ ১ বিলিয়ন ডলার পায়। বাজেট সহায়তা পাওয়ার জন্য বর্তমানে অর্থ উপদেষ্টা বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী- এডিবি, বিশ্বব্যাংক, কোরিয়ার সাথে আলোচনা করছে। এছাড়া বিদেশি ঋণ পরিশোধ এবং গ্রেস পিরিয়ড নিয়েও অর্থ উপদেষ্টা আলোচনা করছেন।
২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা ( বাজেটের ৩২ শতাংশ)। এ ঘাটতি পূরণে, ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নেওয়ার কথা আছে ১ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। বহুল আলোচিত ব্যাংকিং খাত সরকারকে এই পরিমাণ ঋণ দিতে কি এখন সক্ষম? ব্যাংকিং খাতে এখন তীব্র তারল্য সংকট দেখা দিয়েছে। সুশাসনের অভাবের কারণে ইতোমধ্যে ১০টি ব্যাংকের বোর্ড পুনর্গঠন করা হয়েছে। এর প্রভাব পড়েছে সমগ্র আর্থিক খাতে।
যেহেতু ব্যাংকিং খাত বাজেট সহায়তা দিতে অক্ষম, সেহেতু বহুজাতিক উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে বাজেট সহায়তা নিতে হবে। ইতোমধ্যে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়াতে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে বাজেট সহায়তা চাওয়া হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এর ভাষণ অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল থেকে অতিরিক্ত তিন বিলিয়ন ডলার, বিশ্বব্যাংক থেকে অতিরিক্ত এক বিলিয়ন ডলার, জাইকা থেকে অতিরিক্ত এক বিলিয়ন ডলার চাওয়া হয়েছে।
এটা সত্য যে, বাজেট ঘাটতি পূরণে আমরা বিদেশি ঋণের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছি। কিন্তু ঋণ পরিশোধের চ্যালেঞ্জ নিয়ে আমরা কাঠামোগতভাবে কি ভাবছি ? ইউনূস সরকারকে ঋণ পরিশোধের একটা পরিকল্পনা করতে হবে। বিগত সাড়ে ১৫ বছরে বিদেশি ঋণ তিন গুণ বেড়ে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দাঁড়িয়েছে ৬৯ দশমিক ৬৬ বিলিয়ন ডলার। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাজেটের ১৪ দশমিক ৫ শতাংশ ব্যয় হবে ঋণের সুদ বাবদ। বর্তমান অর্থবছরে বিদেশি ঋণ পরিশোধ করতে হবে ৪ দশমিক ০২ বিলিয়ন ডলার, ২০২৫-২৬ এ ৪ দশমিক ০৫ বিলিয়ন ডলার।
আইএমএফের তথ্য মতে, একটা দেশে ঋণ-জিডিপি অনুপাত ৫৫ শতাংশের নিচে থাকলে কোনও ঝুঁকি থাকে না। বাংলাদেশে ঋণ-জিডিপি অনুপাত এখন ৩৫ শতাংশ। আমরা যদি কর কাঠামো এবং কর প্রশাসন নতুন করে পরিবর্তন না করে উন্নয়ন সহযোগীদের ওপর নির্ভর করি, তাহলে ভুল সিদ্ধান্ত হবে। সব সময় উন্নয়ন সহযোগীদের ওপর নির্ভর করলে দেশ বিপদের মুখোমুখি হবে। এ বছরের জুলাই মাসে ছাত্র আন্দোলনের সময় এডিবি, বিশ্বব্যাংক, জাপান, ভারত, চীন ও রাশিয়ার কাছ থেকে অর্থায়নের কোনও প্রতিশ্রুতি পাওয়া যায়নি। এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য রাজস্ব আয়ের কোনও বিকল্প নেই।
ইউনূস সরকারের অন্যতম ভূমিকা থাকবে অর্থনৈতিক সংস্কারে। এর অংশ হিসেবে ব্যাংক খাত সংস্কারের জন্য ইতোমধ্যে টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। এ সংস্কারের জন্য বিশ্বব্যাংক ৪৫ কোটি ডলার এবং এডিবি ১৩০ কোটি ডলার ঋণ সহায়তা দিতে চেয়েছে। বছরের পর বছর রাজস্ব আয় বাড়াতে ব্যর্থ হচ্ছে বাংলাদেশ। আইএমএফ থেকে দেওয়া ঋণের শর্ত হিসেবে বিগত সরকার রাজস্ব আয় বাড়াতে পারেনি বিগত অর্থবছরে। বিগত অর্থবছরে শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ কর-জিডিপি বাড়ানোর কথা ছিল। আইএমএফ এর শর্ত মোতাবেক, ২০২৫-২৬ অর্থবছরে শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ কর-জিডিপি অনুপাত বাড়তে হবে।
রাজস্ব আয় বাড়াতে পারলে বিদেশি ঋণের ওপর এত বেশি নির্ভরশীল হতে হতো না। দুঃখজনক যে, বাংলাদেশে বাস্তবায়িত এবং চলমান মেগা প্রকল্পগুলোর ব্যয় বিশ্বের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর কারণ হলো দুর্নীতি এবং লুটপাট। আমাদের বৈদেশিক ঋণের সিংহভাগ এখন ‘সাপ্লায়ারস ক্রেডিট’। এ ধরনের ঋণে লুটপাটের সুযোগ বেশি থাকে। সাপ্লায়ারস ক্রেডিট-এর আওতায় ঋণদাতারা প্রকল্পের প্লান্ট, যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম ঋণ হিসেবে দিয়ে থাকে। প্রচলিত বাজার মূল্য থেকে অনেক বেশি দামে সরঞ্জাম নিতে হয়। এতে ঋণের পরিমাণ বেড়ে যায় এবং লুটপাটের সুযোগ থাকে।
যদি একটা অর্থনীতিতে ঋণ-জিডিপি অনুপাত বাড়ার সাথে সাথে কর-জিডিপি অনুপাত বাড়তে থাকে, তাহলে ঋণ পরিশোধের কোনও চ্যালেঞ্জ থাকে না। বাংলাদেশে ঋণ-জিডিপি অনুপাত বাড়ার সাথে সাথে কর-জিডিপি অনুপাত কি বাড়ছে? যদি না বাড়ে তাহলে ঋণ পরিশোধের চ্যালেঞ্জ বাড়বে। ইউনূস সরকার পাইপলাইনে থাকা ৪৮ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক সহায়তা ব্যবহারে উদ্যোগ নিয়েছে। যে প্রকল্পগুলোর মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে এবং অতি দ্রুত রিটার্ন আসবে, সে ধরনের প্রকল্পে বৈদেশিক সহায়তা ব্যয় করা উচিত। সাপ্লায়ারস ক্রেডিট আকারে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ ঋণ না নিয়ে স্বল্প সুদে, গ্রেস পিরিয়ড বাড়ানো, ঋণ পরিশোধের মেয়াদ বাড়ানোর শর্তে এখন থেকে বিদেশি ঋণ নিতে হবে।
উল্লেখ্য, আইএমএফ’র একটি মিশন ইতিমধ্যে ঢাকা সফর শেষ করেছে। চলমান ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণ সহায়তার পাশাপাশি আরও ৩০০ কোটি ডলারের ঋণ সহায়তার জন্য আলোচনা হয়েছে। তবে দ্বিপাক্ষিক উন্নয়ন সহযোগীদের চেয়ে বহুজাতিক উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে ঋণ নেওয়া যুক্তিযুক্ত নানা কারণে।
লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক এবং ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর সদস্য।
আপনার মতামত লিখুন :