একজন খ্যাতিমান সাংবাদিক ফেসবুকে একটি পোস্টে লিখেছিলেন, ‘যেসব সাংবাদিক দলীয় হিসেবে পরিচিত হয়েছেন, তারা সাংবাদিকতা ছাড়ুন।’ খুবই যৌক্তিক দাবি। তারা সাংবাদিকতা ছাড়লেই সাংবাদিকতা একটা আস্থার জায়গায় আসে।
সাংবাদিক পেশাটাই ভিন্ন ধাঁচের। নানান দিকের খবরাখবর নিতে তাদের সবদিকে যেতে হয়। ‘সাংবাদিক’ শব্দটার মাঝেও ‘দিক’ শব্দটা আছে। মানে তাদের নিজেদেরও একটা দিক আছে। এই নিজস্ব দিকটা বরবাদ হয়েছে সময়ে-সময়ে। তারা কখনও কখনও হয়েছে আওয়ামী, জাতীয়তাবাদী, জামাতি, বামাতি ইত্যাদি। আর রাজনীতিকদের মতো তাদেরও কারও কারও মধ্যে কথা বলা দূরে থাক, মুখ দেখাদেখিও বন্ধ। মৃত্যুর পর শেষমুখ দেখা বা জানাজায় যাওয়ার পথও রুদ্ধ করে দেওয়ার এক দুর্বিনীত সংস্কৃতি চালু হয় দেশে।
এমন কুসংস্কৃতির মধ্যেই লোকান্তর ঘটে বিএনপি সমর্থিত বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি রুহুল আমিন গাজীর। একাত্তরে রণাঙ্গনের সাহসী এ যোদ্ধার জানাজা ছিল প্রেস ক্লাব প্রাঙ্গণে। তিনি দীর্ঘদিন চাকরি করেছেন জামায়াতের পত্রিকা দৈনিক সংগ্রামে। স্বাভাবিকভাবেই জামায়াত নেতারা তার জানাজায় শরিক হন দলটির আমিরসহ কেন্দ্রীয় নেতারাও। জানাজার আগে তারা ক্লাবের ভেতরে যান। আওয়ামীপন্থি আলোচিত ও আওয়ামী লীগ সমর্থিত সাংবাদিক নেতা ইকবাল সোবহান চৌধুরী, আবুল কালাম আজাদ, মনজুরুল আহসান বুলবুলসহ সাংবাদিকরা এক টেবিলে বসেন। সেই ছবিটি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার এক কর্দমাক্ত ঝড়। যার যা ইচ্ছা মন্তব্য।
এটা আসলে বাস্তবতারই জের। শেখ হাসিনার টানা রাজত্বে সাংবাদিকদের বিভক্তির ছাপেরই প্রকাশ। রাজনীতির ভিন্নমতের লোকদের জানাজায় শরিক হওয়া বা দেখাশোনাকেও অপরাধের আওতায় নেওয়ার চর্চার ছাপ। একজনের মৃত্যুতে জানাজা পড়তে আসা বিপরীতমুখী লোকদের এক জায়গায় দেখলে অবাক-হতবাক হওয়ার বিমারি। এমন অস্থির সময়ের অবসান ঘটে গত ৫ আগস্ট। আওয়ামী লীগ সমর্থিত নেতাদের অনেকে শেখ হাসিনার সরকারের পতন ও পালিয়ে যাওয়ার দিন থেকে প্রেস ক্লাবে যান না। এই জানাজা উপলক্ষে তারা প্রেস ক্লাবে যান। কিন্তু ২০২১ সালে জাতীয়তাবাদী ফোরামের সর্বোচ্চ নেতা রিয়াজউদ্দিন আহমেদের জানাজায় তাদের অনেকে যাননি। সেই বিবেচনায় রুহুল আমিন গাজীর জানাজার উসিলায় তাদের প্রেস ক্লাবে যাওয়ার একটা চিকন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য একেবারে না বোঝার মতো নয়।
এ নিয়ে জাতীয়তাবাদী সাংবাদিকদের মধ্যে কানাঘুষা একবারে অস্বাভাবিক নয়। আবুল কালাম আজাদ সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রেস সচিব বা তথ্য উপদেষ্টা থাকার সময় ইকবাল সোবহান চৌধুরী কী করেছেন, কী বলেছেন- এসব নিয়ে মনোবেদনা থাকাও স্বাভাবিক। এর মধ্যেও তারা যে দিনটিতে প্রেস ক্লাবে গেছেন এটি একটি ঘটনা। সাংবাদিকদের অন্তত নিজেদের মধ্যে মুখ দেখাদেখি যে হলো, সহকর্মীর শেষ বিদায়ে একসঙ্গে চোখের পানি তো মুছলেন। ছোট্টর মধ্যে এটি কি একটি সংস্কার বা সংস্কারের সূচনা বলা যায় না? দেশে ঘৃণা ও বিভাজনের রাজনীতিকে গুডবাই জানানোর প্রতীকী কাজটি সাংবাদিকদের মাধ্যমে শুরু হলো- এ দাবিও তো করা যায়। সরাসরি দলবাজি বন্ধ করতে না বললেও সাংবাদিকদের সেলফ সেন্সর বা নিজে নিজে নিয়ন্ত্রিত না হতে আহ্বান জানানো হয়েছে অন্তর্র্বর্তী সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে। স্বয়ং প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস বলেছেন, সরকারের ত্রুটি ধরিয়ে দিতে। মন খুলে সমালোচনা করতে। এর মধ্য দিয়ে সরকারের বন্দনা, তোষামোদি না করার একটি সংস্কার সূচনা হলো।
বিভিন্ন মহলের কাছে তার এ বার্তা বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যাযোগ্য। আর সাংবাদিকদের জন্য বিশেষ সম্মান ও মর্যাদার। সাংবাদিকদের নিজেদের দিক ঠিক করার একটি মোক্ষম বার্তা ও সুযোগও। একটি দেশে গণতন্ত্র কতটা শক্তিশালী, তার উল্লেখযোগ্য সূচক হলো সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা। কিন্তু এ স্বাধীন থাকার চেয়ে নিজেকে অধীন করে গোটা পেশাটি কলঙ্কিত করার একটি বাতিক সময়ে সময়ে দেখতে হয়েছে। ভুগতেও হয়েছে। তারা সংখ্যায় বেশি নয়, তবে শক্তিতে বলীয়ান। ধারে-ভারে মারাত্মক। তাত্ত্বিক বা পুথিগতভাবে সংবাদমাধ্যমকে বলা হয় গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ। ইংরেজিতে চতুর্থ স্তম্ভ। সেই অবস্থাটা বরবাদ করে গোটা গণমাধ্যমকে কলঙ্কিত করে নিজ তেলে তেলতেলে হওয়া গুটিকতক সাংবাদিককের দুষ্কর্ম আমাদের দেখতে হয়েছে। সরকারের নানা আইন ও বিধির বেড়াজালকে প্রতিষ্ঠিত করতে আগুয়ান এ জীবেরা গোটা সাংবাদিক মহলকে দিকহারা করেছেন। যার অনিবার্য পরিণতিতে সাংবাদিক পেশাটিই সমাজের নানা স্তরে বাঁকা চোখের শিকার। গালমন্দ শোনার পাত্র।
সরকার বা রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বদলের পর রাজনীতিক বা কিছু আমলার গা ঢাকা দেওয়ার সঙ্গে মানুষ পরিচিত। এবার সেখানে যোগ হয়েছে সাংবাদিকদের এদিক-ওদিক চম্পট দেওয়া। পেশাদার সাংবাদিকদের জন্য তা কত বেদনার, জানেন কেবল ভুক্তভোগীরা। এমনিতেই পেশাটি শারীরিক-মানসিকভাবে চরম ঝুঁকির। তার ওপর এ পেশায় একবার জড়িয়ে গেলে আর ফেরার উপায় থাকে না। অন্য কোনো কাজে তারা আর মানানসই হতে পারেন না। তার ওপর আইনি যন্ত্রণা ও অমর্যাদার বিষয় রয়েছে। অন্তর্র্বর্তী সরকার সাংবাদিকদের আবারও মান-ইজ্জতের দিকে যাওয়ার সুযোগ দিয়েছে। এখন সাংবাদিকরা এদিকে-ওদিকে না গিয়ে কোনদিকে কেবলামুখী হবেন, এটা তাদেরই বিষয়। নতুন কোনো রাজনৈতিক গলিতেই ঢুকবেন, না নিজেদের জাতে তুলবেন?
সাংবাদিকতার নামে মোটাতাজা হওয়া দলকানা ছাড়া সবারই জানা, গত দশকের বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় ক্যাজুয়ালটির শিকার ছিল গণমাধ্যম। রক্তক্ষয়ী জুলাই-আগস্ট ২০২৪-এর অভ্যুত্থান-পরবর্তী পর্যায়ে মুক্ত সাংবাদিকতা চর্চার সুযোগ এসেছে। পূর্ববর্তী সরকারের আমলে যেহেতু অনুসন্ধানী প্রতিবেদন লিখতে উদ্যোগী হতে পারেননি, তারা এখন কোন মুখে পেশাদার হবেন এমন ইতস্ততের মধ্যেও চাইলে কাজটি অন্তত শুরু করতে পারেন। পুরো দোষ কোনো সরকার বা মহলকে না দিয়ে নিজের কাছেও কিছু রাখা চাই। ভুল শিকার করে কান ধরে ওঠবসের দরকার পড়ে না। একটু আত্মসমালোচনা ও সংশোধনই যথেষ্ট। মনে রাখতে হবে, রাষ্ট্র পরিচালনার মতোই মিডিয়াকে করায়ত্ত করে ‘স্টিক অ্যান্ড ক্যারোট আপ্রোচ’ (লাঠির সঙ্গে গাজর) আখেরে নিস্তার দিতে পারেনি। একটি গোষ্ঠীকে হালুয়া-রুটিতে রেখে বাকিদের ভয় দেখিয়ে শেষতক চুপ রাখা যায়নি।
যার জেরে এ শাসন-তোষণ কেয়ামত পর্যন্ত জারি রাখা যায়নি। অনুগতরা শেষদিকে পালানোর গলি খুঁজেছেন। ক্ষমতার বড় ভাইরা পালানোর সময় তাদের নিয়েও যাননি। হিজ হিজ-হুজ হুজে যার যার মতো যে যেখানে পেরেছেন আপনা প্রাণ বাঁচিয়েছেন। অথচ তারা রাষ্ট্রের চতুর্থ খাম্বা। এই খাম্বা বা স্তম্ভের অপমানের ভাগীদার হতে হয়েছে মাঠে কাজ করা পেশাদার সাংবাদিকদেরও। লাজ-শরমে প্রিজারভেটিভ মাখা চম্পটওয়ালাদের কথা আলাদা। তাদের বাঁচতে পেরেই সন্তুষ্টি। বিষয়টি গোটা পেশার জন্য একটি ধাক্কা। এ ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার রাস্তা করে দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা, তথ্য উপদেষ্টাসহ সরকারের শীর্ষে আসীনরা। এখন সুযোগটি নেওয়ার পর্ব। বিবেক ও চিন্তার স্বাধীনতার সদ্ব্যবহারের সক্ষমতা ও সৎসাহসে ঘাটতির মধ্যেও পেশাদার-কমিটেড সাংবাদিকরা তা অন্তত শুরুটা করতে পারেন। আর শুরুতে একটু-আধটু আছাড় খেলেও পরে অবশ্যই দাঁড়াবে। দিক ঘুরবে নিজের দিকে।
পেশাদারিত্ব হারানো গণমাধ্যমের যুগে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারের মধ্যে সাংবাদিকদের সেই সুযোগ দেওয়ার প্রবণতা স্পষ্ট। নৈতিকতা হারানোর পাশাপাশি পাঠক বা দর্শক হারানো মিডিয়া রাজস্ব আয়ের সংকটে ভুগছে। ‘এসো নিজে করি’ অনুশীলনের মতো তাদের নিজে নিজে ঘুরে দাঁড়ানোর অবস্থা নেই। তাদের ঘুরে দাঁড়াতে সরকার ও অংশীজনের উদ্যোগ দরকার। নইলে ঘুরে দাঁড়াতে গিয়ে তাদের মধ্যে গিরগিটির রং বদলানোর কসরতের শঙ্কা থাকবে। টানা ১৫-১৬ বছরের অভ্যাস-চর্চার একটি বিষয়ও আছে। গিরগিটি রং বদলায় আত্মরক্ষায়, মানুষ রং বদলায় কেবল স্বার্থরক্ষায়ই নয়, অনেকে অভ্যাসেও রং বদলায়। এখানেই ভয়। গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে নতুন বাংলাদেশে অনেক কিছু সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে। এর মধ্যে অবশ্যই গণমাধ্যমকে প্রাধান্য দিতে হবে। নইলে অন্যসব সংস্কারে ডিস্টার্ব হবে। স্বশাসিত পেশা ও ব্যবস্থা গণমাধ্যম ও সাংবাদিকতাকে মর্যাদায় ফেরাতে না পারলে, রাজনীতির চোরাগলি থেকে রক্ষা করতে না পারলে গিরগিটির মতো রং পাল্টানোর বিমারি কোনোদিন সারবে না। চাটুকারিতা, মোসাহেবি, তোষামোদি, স্তাবকতা, পদলেহন একটাও সাংবাদিকের কাজ নয়। পেটে ভাত না থাকলেও নামে তারা ‘মহান’।
এই মহত্ত্ব কীভাবে নানা মহলে আদাব-সালামে ক্ষয় হয়, নানান ভাইয়ের খাসকামরায় হাত কচলানিতে বরবাদ হয়, তা নতুন করে বলার দরকার পড়ে না। কারণে-অকারণে এমনিতেই সাংবাদিকদের তেলবাদিক-চাম্বাদিকসহ কত গালমন্দ হজম করতে হয়। আলু, পটোল, ডাঁটা, ঝিঙা, পুঁইশাক বাদ দিয়ে বেগুনবাদিকও যোগ হয়েছে তাদের সঙ্গে। এমন অবস্থায় আর এদিক-ওদিক নয়, নিজের দিক এখন সাংবাদিকদেরও খুঁজতে হবে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সাংবাদিকদের সংবিধান কর্তৃক স্বীকৃত মৌলিক অধিকার। আর অধিকার মানে মর্যাদা। কোনো দল বা পক্ষের কাছে মাথা নুইয়ে, হাত চুলকিয়ে নিজেকে দলীয় কর্মী বা চাকর-নফরে পর্যবসিত করার নোংরা পথে হাঁটা একান্তই যার যার বিষয়। যারা যায় তারা খেটে খাওয়া নয়, চেটে খাওয়া সম্প্রদায়। কিন্তু পরিমাপটা হয়ে যায় গড় হরিবলে একই পাল্লায়। পেশাদার সাংবাদিকদের জন্য তা মনোবেদনার। ###
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
আপনার মতামত লিখুন :