ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর, ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
বিশেষ সাক্ষাতকারে গভর্নর আহসান এইচ মনসুর

৩৬ হাজার কোটি টাকা বিদেশি  দায় রেখে গেছে হাসিনা সরকার

দৈনিক নতুন সংবাদ | তাকী মোহাম্মদ জোবায়ের সেপ্টেম্বর ১৫, ২০২৪, ১২:১১ এএম ৩৬ হাজার কোটি টাকা বিদেশি  দায় রেখে গেছে হাসিনা সরকার

বিদেশি পাওনাদারদের ৩৬ হাজার কোটি টাকা পরিশোধ না করে দায় রেখে গেছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন  আওয়ামী লীগ সরকার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রায় যা প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলার। এই দায় পড়েছে বর্তমান অন্তর্র্বতী সরকারের ঘাড়ে। তবে রিজার্ভ ভেঙে এই দেনা শোধ করবে না বাংলাদেশ। বাজার থেকে ডলার কিনে ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন অংশীদারদের থেকে ঋণ নিয়ে এই দেনা শোধ করা হবে। 
গত বৃহস্পতিবার (১২ সেপ্টেম্বর) বাংলাদেশ ব্যাংকে নিজ কার্যালয়ে নতুন সংবাদকে দেওয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর এসব কথা বলেন। সাক্ষাৎকারে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি, ব্যাংক খাতের সংস্কারসহ আর্থিক খাতের নানা সমস্যা-সম্ভাবনা নিয়ে অকপটে কথা বলেন তিনি। 


গভর্নর বলেন, আগের সরকার বিদেশি ঋণের অনেক অর্থ পরিশোধ করতে পারেনি। শুধু বিদ্যুৎ খাতেই দেড় থেকে দুই বিলিয়ন ডলারের মতো বকেয়া রয়েছে। ভারতের আদানি গ্রুপই বাংলাদেশের কাছে ৮শ মিলিয়ন ডলার পাবে। এগুলোতো শোধ করতে হবে। সার আমদানির ক্ষেত্রে কিছু বকেয়া আছে। বিমানের বকেয়া আছে। সব মিলিয়ে আগের সরকারের আমলে আমাদের প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলারের মতো অপরিশোধিত দেনা রয়ে গেছে। 


আহসান এইচ মনসুর বলেন, আমরা এই দেনাগুলো পরিশোধ করতে পারবো। আমাদের ২০ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ রয়েছে। তবে এই দেনা শোধে আমরা রিজার্ভে হাত দেব না। বাজার থেকে ডলার কিনে ধীরে-ধীরে শোধ করবো। হয়তো ছয় মাস সময় লাগবে, লাগুক। আমরা আইএমএফের কাছে টাকা চেয়েছি, এডিবির কাছে টাকা চেয়েছি। তাদের টাকাটা পেলেও এই বকেয়াগুলো শোধ হয়ে যাবে। 
‘বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়াবেই’ উল্লেখ করে এই জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ বলেন, ইতোমধ্যে আমরা ঘুরে দাঁড়ানোর পর্যায়ে চলে এসেছি। আমাদের নিচের দিকে যাওয়ার আর কোন আশঙ্কা আমি দেখছি না। 


নিজেদের তিনটি প্রধান লক্ষ্য তুলে ধরে গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, আমাদের প্রচেষ্টা হচ্ছে মুদ্রা প্রবাহের সংকোচন নীতি বজায় রেখে মূল্যস্ফীতি ও মুদ্রার বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখা এবং আর্থিক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা। 
বাংলাদেশের অর্থনীতি শ্রীলংকার পর্যায়ে গেছে অনেকের এমন অভিমতের বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করে গভর্নর বলেন, এটি সঠিক নয়। আমরা শ্রীলঙ্কার মতো ভঙ্গুর নই। আমরা কিন্তু এখনো ন্যূনতম রিজার্ভ সংরক্ষণের সীমা অতিক্রম করিনি। আমাদের এখনো বিশ বিলিয়ন ডলারের বেশি রিজার্ভ রয়েছে। যা দিয়ে তিন মাসের বেশি আমদানি ব্যায় মেটানো সম্ভব। 


বাংলাদেশের অর্থনীতির ইতিবাচক ধারার আরো দুটি দিক উল্লেখ করেন গভর্নর। তিনি বলেন, আমাদের এখনকার রেমিট্যান্স প্রবাহ আগের তুলনায় প্রায় ২৫ থেকে ৩০ শাতাংশ বেড়ে গেছে। এটা একটি ভালো দিক। এছাড়া আমাদের মুদ্রা বিনিময় হার কিন্তু প্রায় স্থির হয়ে গেছে। গত তিন মাসের বেশি সময় ধরে ডলারের বিনিময় হার ১২০ টাকায়ই আছে। এই স্থিতিশীলতা আমরা ধরে রাখবো। আমরা সুদ হার বাড়িয়ে, বাজারে অর্থ প্রবাহ আরো সংকুচিত করে মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনবো। গতমাসে মূল্যস্ফীতি ১ দশমিক ৪ শতাংশ কমেছে। এটা যদি আমরা ধরে রাখতে পারি, আগামীতে মূল্যস্ফীতি যদি কমিয়ে ৫ থেকে ৭ শতাংশের মধ্যে নিয়ে আসতে পারি, তাহলে মানুষের পুরোপুরি আস্থা চলে আসবে। 


বিগত সরকারের আমলে আর্থিক খাতে অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে আহসান এইচ মনসুর বলেন, বিগত দিনে আর্থিক খাত ভয়নকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেক রকমের লুটতরাজ, অপকর্মের মাধ্যমে অনেকগুলো আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে ভয়ানকরকম ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়েছে, কোন সন্দেহ নেই। সমস্যাতো পরিচালনা পর্ষদেই ছিল। তারাই মালিক হয়ে ব্যাংক লুটপাট করেছিল। 


তবে গত এক মাসের সংস্কার কার্যক্রমে সাফল্যের কারণে আশার আলো দেখতে পাচ্ছেন আইএমএফ কর্মকর্তা হিসেবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অর্থনীতি সংস্কারের দায়িত্বপালনকারী এই অর্থনীতিবিদ, যিনি বিশেষ সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। আহসান এইচ মনসুর বলেন, এখন আমরা ব্যাংকের পর্ষদগুলো পরিবর্তন করে দিয়েছি। ভালো মানুষগুলোই এখন ব্যাংক পরিচালনা করছে। আমি আশা করবো, আমানতকারীরা তাদের আস্থা ফিরে পাবে। তারা ব্যাংকগুলোতে আবার স্বাভাবিকভাবে ফিরে আসবে। আগের মতোই ব্যবসা পরিচালনা করবে। বর্তমানে আর্থিক খাত নিয়ে আমি উৎসাহিত বোধ করছি। উদাহরণ হিসেবে যদি বলি, ইসলামী ব্যাংক ভায়নকরকম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এটি কিন্তু ঘুরে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। তাদের নগদ অর্থের সংকট কিন্তু আগের মতো নেই। মানুষ এখানে আবার টাকা জমা দিচ্ছে, আবার তুলতেও পারছে। তাদের সংকটটা কিন্তু অনেকখানি কেটে গেছে। 


সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠনের মাধ্যমে ইতোমধ্যে অনেকখানি সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়েছে বলে বিশ্বাস করেন গভর্নর। তিনি বলেন, নবগঠিত পর্ষদগুলোর সঙ্গে আমাদের প্রতি সপ্তায়ই সভা হচ্ছে। আমরা তাদেরকে আশ্ব^স্ত করছি এবং প্রয়োজনীয় সহায়তাও দিচ্ছি। সবমিলিয়ে আমরা আশা করি, সংকটের তলানিটা আমরা দেখে ফেলেছি। এখন আমরা উপরের দিকে নজর দেব। 


বড় গ্রাহকদের ঋণ দেওয়া নিরুৎসাহিত করলে আর্থিক খাতে তারল্য সংকট কেটে যাবে, অনেক বিশ্লেষকের এমন মতামত গভর্নরের নজরে আনলে তিনি বলেন, ছোট গ্রাহকের পাশাপাশি বড় গ্রাহককে বড় ঋণও দিতে হবে। কারণ, তারতো চাহিদা বেশি। কার্যক্রম অনেক বড়। আমদানি-রপ্তানি সবকিছুই বেশি হয়। কাজেই তাকে অবশ্যই বেশি ঋণ দিতে হবে। 


তবে এক্ষেত্রে সতর্ক করে দিয়ে আহসান এইচ মনসুর বলেন, ঋণ যাতে এক জায়গায় কেন্দ্রীভূত না হয়, সেটাও নিশ্চিত করতে হবে। এখানে দুটো জিনিস নিশ্চিত করা দরকার ছিল, যা আগে করা হয়নি। সেটা হলো, একক গ্রাহক ঋণসীমা, যা ব্যাংকের মূলধনের ২৫ শতাংশের বেশি হবে না। এটা অনুসরণ করা উচিত প্রতিটি ব্যাংককে। দ্বিতীয়ত, ২৫ শতাংশ করে অনেকগুলো ব্যাংক থেকে নিতে পারে। সেই ক্ষেত্রে আমাকে দেখতে হবে, মোট ঋণের পরিমাণও যাতে খুব বেশি না হয়। এ দুটো জিনিস ও গ্রাহকের ঋণ পরিশোধের ইতিহাসের ওপর নির্ভর করে ঋণ দিতে হবে। 


‘বড় প্রতিষ্ঠানকে বিবেচনায় নিতেই হবে’ উল্লেখ করে গভর্নর বলেন, ছোট প্রতিষ্ঠানের চাহিদা ও বড় প্রতিষ্ঠানের চাহিদা এক হবে না। আবার বড় প্রতিষ্ঠানকেতো আমি মারতেও পারবো না। হাজার হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারি এখানে চাকরি করে। 


ব্যাংক খাত সংস্কারের লক্ষ্যে টাস্কফোর্স গঠনের কথা উল্লেখ করে গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, টাস্কফোর্স রবিবার থেকে কাজ শুরু করবে। এর অধীনেই আমরা ব্যাংকের স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগের জন্য একটা ‘পুল’ (যোগ্য ব্যক্তিদের তালিকা) তৈরি করবো। কোন ব্যাংক স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগের ক্ষেত্রে এই পুল থেকে পছন্দের ব্যক্তিকে বেছে নিবে। আমাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে, ব্যাংকের স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে যাতে কারো আত্মীয়, বন্ধু বা শুভাকাঙ্ক্ষী আসতে না পারে। আমরা চাই যোগ্য, সৎ এবং যাদের বিষয়ে নেতিবাচক কোন অভিযোগ নেই, এমন ব্যক্তিদের বিভিন্ন ব্যাংকে ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দিতে। 


বিশেষ ক্ষেত্রে এই পুলের বাইরে থেকেও স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগের সুযোগ থাকার কথা জানিয়ে গভর্নর বলেন, যদি খুব সুযোগ্য কোন ব্যক্তি হন যিনি আমাদের গঠিত পুলে নেই, তার নাম প্রতিষ্ঠান প্রস্তাব করতে পারবে। বাংলাদেশ ব্যাংক বিবেচনা করে তাকে অনুমোদন দেবে। ###
 

Side banner