শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের টানা প্রায় ষোল বছরের শাসনকালে বিরোধীমত দমনে যেসব হয়রানিমূলক মামলা হয়েছে, সেসব মামলা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। শুধু সিদ্ধান্তই নয়, এরইমধ্যে প্রয়োজনীয় উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক কারণে হওয়া হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহারের লক্ষ্যে গতকাল রোববার দুটি কমিটি গঠন করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ। এর মধ্যে একটি জেলা পর্যায়ের কমিটি এবং অন্যটি মন্ত্রণালয় পর্যায়ের কমিটি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ সংক্রান্ত এক প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। সেখানে কমিটি দুটির কাজের ধরন ও কাজের পরিধিও নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে।
তবে, রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন ষোল বছরে যেসব মামলা করেছে, সেসব মামলার বিষয়ে করণীয় পরে নির্ধারণ করবে অন্তর্বর্তী সরকার। দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪ এর আওতাধীন মামলাগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলাগুলো দ্য ক্রিমিনাল ল অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট, ১৯৫৪ এর ১০(৪) ধারার বিধানমতে কমিশনের লিখিত আদেশ ছাড়া প্রত্যাহার করা যায় না। তাই এ ধরনের মামলা চিহ্নিত করে তালিকা তৈরি করবে সরকার। এ ধরনের মামলার বিষয়ে করণীয় পরে নির্ধারণ করা হবে।
এদিকে, রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহারের বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্যোগে কিছুটা স্বস্তি ফিরেছে বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে। টানা ষোল বছর জেলের ঘানি টানতে-টানতে আর পালিয়ে থাকতে-থাকতে দলটির লাখ-লাখ নেতাকর্মী আগে থেকেই ক্লান্ত, সর্বস্বান্ত। এখন অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্যোগে আশার আলো দেখছেন নেতাকর্মীরা। দলটির জ্যেষ্ঠ নেতারা অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর-পরই হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে আসছিল। বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এই বিষয়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে চিঠির মাধ্যমে মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানানোরও সিদ্ধান্ত ছিল।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গতরাতে নতুন সংবাদকে বলেছেন, ‘বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দেড় লাখ মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা দিয়েছে শেখ হাসিনার স্বৈরাচারি সরকার। এসম মামলায় আসামি করা হয়েছে ৬০ লাখ নেতাকর্মীকে।’ বিএনপি মহাসচিব আরও বলেন. ‘আমরা অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে সকল মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের আশা রাখছি।’
গতকাল জারি হওয়া স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন থেকে জানা যায়, রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহারের জন্য আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে জেলা পর্যায়ের কমিটির সভাপতি জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে আবেদন করতে হবে। জেলা কমিটির কাছ থেকে সুপারিশপ্রাপ্তির পর সেসব পরীক্ষানিরীক্ষা করা এবং প্রত্যাহারযোগ্য মামলা চিহ্নিত করে তালিকা প্রস্তুত করা ও মামলা প্রত্যাহারের কার্যক্রম গ্রহণ করবে মন্ত্রণালয় পর্যায়ের কমিটি।
বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও অন্যান্য নানা কারণে রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ও নিরীহ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলা হয়েছে। সেগুলো প্রত্যাহারে সুপারিশের লক্ষ্যে সরকার এই দুটি কমিটি গঠন করেছে বলেও প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ রয়েছে।
জেলা পর্যায়ের কমিটির সভাপতি হিসেবে থাকবেন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, সদস্যসচিব অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এবং সদস্য পুলিশ সুপার (মহানগর এলাকার জন্য পুলিশের একজন ডেপুটি কমিশনার) ও পাবলিক প্রসিকিউটর (মহানগর এলাকার মামলাগুলোর জন্য মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর)।
জেলা পর্যায়ের কমিটির কার্যপরিধি ও কর্মপদ্ধতি সম্পর্কেও প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে। তা হলো রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহারের জন্য আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে সংশ্লিষ্ট জেলার জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে আবেদনপত্র দাখিল করতে হবে। আবেদনের সঙ্গে এজাহার ও প্রযোজ্য ক্ষেত্রে অভিযোগের সত্যায়িত কপি দাখিল করতে হবে। আবেদনপ্রাপ্তির সাত কর্মদিবসের মধ্যে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট দরখাস্তটি জেলার পাবলিক প্রসিকিউটরের (ক্ষেত্রবিশেষে মেট্রোপলিটান পাবলিক প্রসিকিউটর) কাছে মতামতের জন্য পাঠাবেন। আবেদনপ্রাপ্তির ১৫ কর্মদিবসের মধ্যে পাবলিক প্রসিকিউটর (ক্ষেত্রবিশেষে মেট্রোপলিটন পাবলিক প্রসিকিউটর) তাঁর মতামত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বরাবর পাঠাবেন। পাবলিক প্রসিকিউটরের মতামত সংগ্রহ করে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আবেদনটি সাত কার্যদিবসের মধ্যে জেলা কমিটির সভায় উপস্থাপন করবেন।
জেলা কমিটির কাছে যদি মনে হয় মামলাটি রাজনৈতিক বা অন্য কোনো উদ্দেশ্যে হয়রানির জন্য করা হয়েছে, তাহলে মামলাটি প্রত্যাহারের জন্য কমিটি সরকারের কাছে সুপারিশ করবে। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সেই সুপারিশ, মামলার এজাহার, অভিযোগপত্রসহ আবেদন পাওয়ার ৪৫ কার্যদিবসের মধ্যে নির্দিষ্ট ছক অনুযায়ী তথ্যাদিসহ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠাবেন।
মন্ত্রণালয় পর্যায়ের কমিটির কার্যপরিধি ও কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, জেলা কমিটির কাছ থেকে সুপারিশপ্রাপ্তির পর মন্ত্রণালয় পর্যায়ের কমিটি সেগুলো পরীক্ষানিরীক্ষা করবে। প্রত্যাহারযোগ্য মামলা চিহ্নিত করে তালিকা প্রস্তুত করবে এবং মামলা প্রত্যাহারের কার্যক্রম গ্রহণ করবে।
মন্ত্রণালয় পর্যায়ের কমিটির সভাপতি হিসেবে থাকবেন আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা এবং সদস্যসচিব হবেন জননিরাপত্তা বিভাগের আইন- ১ শাখার উপসচিব/জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব/সহকারী সচিব। আর সদস্য হিসেবে থাকবেন জননিরাপত্তা বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব, অতিরিক্ত সচিব (আইন ও শৃঙ্খলা) ও যুগ্ম সচিব (আইন) এবং আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি (যুগ্ম সচিব পর্যায়ের নিচে নয়)। ###
আপনার মতামত লিখুন :