ঢাকা মঙ্গলবার, ২২ অক্টোবর, ২০২৪, ৭ কার্তিক ১৪৩১

অপ্রকাশ্যে ক্ষুব্ধ তারেক রহমান

দৈনিক নতুন সংবাদ | বিশেষ প্রতিনিধি, ঢাকা অক্টোবর ২, ২০২৪, ১১:৪৫ পিএম অপ্রকাশ্যে ক্ষুব্ধ তারেক রহমান

রাষ্ট্র সংস্কারে যেকোনও মূল্যে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারকে এখনও সফল দেখতে চান বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। সফলতার প্রয়োজনে বিএনপির পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় সহায়তা-সমর্থন জোগাতে দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের এরই মধ্যে নানা নির্দেশনা দিয়ে রেখেছেন তিনি। ‘অন্তর্বর্তী সরকারকে কোনোভাবেই ব্যর্থ হতে দেওয়া যাবে না-’ গত ১৭ সেপ্টেম্বর ঢাকার নয়াপল্টনের সমাবেশে ভার্চুয়ালি বক্তৃতাকালে এমন মন্তব্য করে অন্তর্বর্তী সরকারপ্রশ্নে দলের অবস্থান অনেকটাই স্পষ্ট করেছিলেন বিএনপির দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নেতা। কিন্তু দিন যতো গড়াচ্ছে, অন্তর্বর্তী সরকারের চলমান কিছু-কিছু কর্মকাণ্ডে বিএনপি নেতাদের মধ্যে ‘মৃদু ক্ষোভ’ তৈরি হচ্ছে। খোদ বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও অন্তর্বর্তী সরকারের কিছু-কিছু কর্মকাণ্ডে অসন্তুষ্ট হয়ে আছেন। কিছু বিষয়ে অপ্রকাশ্যে ক্ষুব্ধও রয়েছেন তিনি। তবে, ক্ষোভের বিষয়টি কোনোভাবে এখনই প্রকাশ্যে আনতে নারাজ তারেক রহমান। সংস্কারপ্রশ্নে সহায়তার বিষয়ে ইতিবাচক থেকেই অন্তর্বর্তী সরকারকে আরও ‘যৌক্তিক সময়’ দিতে চান তিনি। বিএনপির দায়িত্বশীল ও তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ একাধিক সূত্রে কথা বলে জানা গেছে এমন তথ্য।

 

সূত্রগুলো জানিয়েছে, ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী সরকারের পতনশেষে ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর নতুন সরকারের কাছে জাতীয় স্বার্থে বিএনপির যা কিছু প্রত্যাশা ছিল, প্রায় দুই মাসের মাথায় এসে প্রত্যাশার সঙ্গে অনেক বিষয়ে প্রাপ্তির ফারাক স্পষ্ট হচ্ছে। বিশেষ করে শেখ হাসিনার প্রায় ষোল বছরের স্বৈরশাসনের দোসরদের আইনের আওতায় নিয়ে আসার বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের ‘ধীরনীতি’ নিয়ে এরই মধ্যে বিএনপি নেতাদের মধ্যে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল থেকে শুরু করে শেখ হাসিনার ‘কিচেন কেবিনেটের রুই-কাতলারা’ এখনও কেনো ধরাছোঁয়ার বাইরে, এই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতাদের মনে। এরই মধ্যে গণমাধ্যমে খবর এসেছে, রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে প্রশাসনে শেখ হাসিনার যেসব দোসর ছিলেন, যাদের নির্দেশে ছাত্র-জনতার ওপর জুলাই বিপ্লবে বেপরোয়া গুলি চালানো হয়েছিল; তাদের অনেকেই এরই মধ্যে ভারতসহ বিভিন্ন দেশে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন। এসব বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে স্পষ্ট কোনো বার্তা দেওয়া হচ্ছে না। 

 

বিএনপি নেতাদের অনেকেরই সন্দেহ, অন্তর্বর্তী সরকারের বর্তমান প্রশাসনের কারও-কারও সহযোগিতায় ‘দুর্নীতিবাজ ও খুনিরা’ পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন। আর এই সন্দেহ যদি সত্যিই হয়, সেক্ষেত্রে অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত না হওয়ার কারণে মানুষের মনে ক্ষোভ থেকেই যাবে, ছাত্র-জনতার বিপ্লরের সফলতাও থেকে যাবে অপূর্ণ।

 

বিএনপি নেতারা মনে করেন, সরকারের অনেক সিদ্বান্তই নেওয়া হচ্ছে প্রয়োজনের তুলনায় ধীরগতিতে। যার সুফল পাচ্ছে শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনের দোসররা। দুর্নীতি দমন কমিশন থেকে শুরু করে প্রশাসনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদে এখনও হাসিনার  অনুগতরা থেকে যাওয়াই বিস্মিত হচ্ছে বিএনপি নেতারা। দুর্নীতিবাজদের বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা এবং ব্যাংক হিসাব জব্দের ক্ষেত্রেও অন্তর্বর্তী সরকার ধীরনীতিতে এগিয়েছে বলে বিএনপি নেতাদের ধারণা।

 

জুলাই বিপ্লবে ছাত্র-জনতা হত্যার সহযোগী ছিলেন এবং ইতিমধ্যে যাঁরা হত্যা মামলার আসামি, শেখ হাসিনা সরকারের এমন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, মন্ত্রী-সংসদ সদস্যসহ সংশ্লিষ্ট আওয়ামী লীগের নেতারা এখনও গ্রেপ্তার না হওয়ায় গত মঙ্গলবার রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সভায়ও প্রশ্ন তোলা হয়েছে। বিএনপির নেতারা মনে করেন, হত্যা মামলার পরেও এসব আসামি কীভাবে পালালেন, কারা তাঁদের পালিয়ে যেতে সহযোগিতা করেছে, এসব বিষয়ে জনমনে যথেষ্ট প্রশ্ন ও উদ্বেগ আছে। স্থায়ী কমিটির ওই সভায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ভার্চুয়ালি যুক্ত থেকে সভাপতিত্ব করেছেন। স্থায়ী কমিটির ওই সভায় অন্তর্বর্তী সরকারের কর্মকান্ড আরও গভীরভাবে পর্যালোচনার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।

 

এদিকে, অন্তর্বর্তী সরকারের রাষ্ট্র সংস্কারের উদ্যোগের বিষয়ে দলীয় অবস্থান ঠিক করতে ছয়টি কমিটি গঠনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে বিএনপির স্থায়ী কমিটির মঙ্গলবারের সভায়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এরই মধ্যে কমিটিও গঠন করা হয়েছে। এই কমিটিগুলো অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করে সংস্কার বিষয়ে দলের কর্মকৌশল ঠিক করে তা জাতির সামনে তুলে ধরবে। দলের নীতিনির্ধারকেরা জানিয়েছেন, রাষ্ট্রসংস্কার নিয়ে তাদের পক্ষ থেকে মতামত ও সুপারিশ তুলে ধরা হবে। 

 

গঠিত কমিটিগুলো হলো- সংবিধান সংশোধন, বিচার বিভাগ, পুলিশ বিভাগ, প্রশাসন, দুর্নীতি দমন কমিশন ও নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন সংক্রান্ত। 


বিএনপির দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, মূলত সরকার গঠিত কমিটির সংস্কার বিষয়ক কার্যক্রমের উপর ভিত্তি করে দলের কৌশল তৈরি ও সে অনুসারে প্রাসঙ্গিক কাজ প্রণয়ন করতে কাজ করবেন এই ছয় কমিটির সদস্যরা। সংস্কার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করলে বিএনপি যাতে তাদের পরামর্শ তুলে ধরতে পারে, সেই প্রস্তুতিও নেবে এইসব কমিটি। 

 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলের এক গুরুত্বপূর্ণ নেতা নতুন সংবাদকে বলেন, সংস্কার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠকের অংশ হিসেবে আগামী শনিবার প্রথম বৈঠক হতে পারে। ওই বৈঠকে বিএনপির একটি প্রতিনিধিদল অংশ নেবে। বৈঠকে বিএনপি কিছু বিষয়ে তাদের প্রাথমিক প্রস্তাব তুলে ধরতে পারে। 

 

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, সংস্কারের বিষয়ে দলের অবস্থান নির্ধারণ ও প্রসঙ্গিক কাজ করাই হবে বিএনপি গঠিত সংস্কারবিষয়ক কমিটির মূল কাজ। সরকার চাইলে বিএনপি সংস্কার নিয়ে আলোচনা করবে। 

 

কোন কমিটিতে কারা আছেন : স্থায়ী কমিটির সভায় প্রস্তাবিত ৬টি কমিটির মধ্যে সংবিধান পুনর্গঠন কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনকে। সদস্য আছেন- স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ, বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার নওশাদ জমির, ব্যারিস্টার কায়সার কামাল, ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল, অধ্যাপক বোরহান উদ্দিন, অধ্যাপক ড. মাহফুজুল হক সুপন ও প্রফেসর ড. নাজমু জামান ভূঁইয়া ইমন। 

 

বিচার বিভাগ সংস্কার কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকারকে। সদস্য হলেন- অ্যাডভোকেট জয়নাল আবেদিন, বিচারপতি মিফতাহ উদ্দিন চৌধুরী, বিচারপতি মোহাম্মদ রইস উদ্দিন, ব্যারিস্টার কায়সার কামাল, বিচারক ইকতেদার হোসেন, ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল, ব্যারিস্টার নওশাদ জমির, ব্যারিস্টার নাসির উদ্দিন অসিম। 

 

পুলিশ বিভাগ সংস্কার কমিটির আহ্বায়ক হয়েছেন স্থায়ী কমিটির সদস্য মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বীরবিক্রম। সদস্য হচ্ছেন- সাবেক স্বরাষ্ট্র সচিব জহিরুল ইসলাম, সাবেক আইজিপি আবদুল কাইউম, সাবেক ডিআইজি খোদা বক্স ও সাবেক ডিআইজি খান সাঈদ হাসান। 

 

প্রশাসন সংস্কার কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদকে। সদস্যরা হলেন- সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আবদুল হালিম, ইসমাইল জবিউল্লাহ ও সাবেক সচিব মনিরুজ্জামান খান। 

 

দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে সাবেক বিচারপতি মিফতাহ উদ্দিন চৌধুরী, বিচারপতি শরফুদ্দিন চাকলাদার ও বিচারপতি এএফএম আবদুর রহমান নাম রয়েছে। সদস্য হচ্ছেন- ব্যারিস্টার বদরুদ্দোজা বাদল ও সাবেক সচিব আবদুর রশিদ। 

 

নির্বাচন কমিশনবিষয়ক সংস্কার কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খানকে। সদস্য হচ্ছেন- স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান ও সালাহউদ্দিন আহমেদ,  ইসমাইল জবিউল্লাহ ও সাবেক সচিব আবদুর রশিদ। 


 

Side banner