Daily Natun Sangbad
Bongosoft Ltd.
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ৪ আশ্বিন ১৪৩১

তিনি দানবের দোসর!

দৈনিক নতুন সংবাদ | তাকী মোহাম্মদ জোবায়ের, ঢাকা : আগস্ট ১৮, ২০২৪, ০৪:০৭ পিএম তিনি দানবের দোসর!
ফাইল ছবি

কৃতকর্মে ঠিক কী উপাধী প্রাপ্য তিনি, ছোট প্রশ্নের উত্তরে মিলেছে আরও ছোট উত্তর- ‘তিনি দানব’। সময়ের হিসেবে ত্রিশ সেকেন্ডেরও কম সময় পর যোগ করলেন, ‘তিনি ব্যাংক খাতের দানবের দোসর’। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পালিয়ে যাওয়া সদ্যবিদায়ী-পদত্যাগকারী গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের বিষয়ে এমনই মন্তব্য ছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার। একইপ্রশ্নে বাংলাদেশ ব্যাংকের উচ্চ, মধ্যম ও অপেক্ষাকৃত জুনিয়র কর্মকর্তারা যেসব মন্তব্য করেছেন, ভাষাগত-অর্থগত দিক থেকে সবই ছিল কাছাকাছি। দু’একজন দানবের পাশাপাশি ব্যাংক খাতের রাক্ষসদের দোসর হিবেবেও আখ্যা দিয়েছেন তাঁকে।
দেশের আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বোচ্চ পদে টানা ২৫ মাস দায়িত্ব পালনশেষে আব্দুর রউফ তালুকদারের এমন নেতিবাচক উপাধীপ্রাপ্ত হওয়ার নেপথ্য কারণ তিনি নিজেই। কর্মকালে দম্ভ, অনিয়ম-দুর্নীতি, লুটপাট ও স্বেচ্ছাচারিতার এমনসব ঘটনা তিনি ঘটিয়েছেন, যা বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাছে কলঙ্কিত অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। ব্যাংক খাতের এমন কোনও অনিয়ম-লুটপাট নেই, যার সঙ্গে আব্দুর রউফ তালুকদার জড়িত ছিলেন না। সাবেক গভর্নর ফজলে কবিরের ধারাবাহিকতায় রউফ তালুকদারেরও পূর্ণ আনুকূল্য পেয়েছে প্রভাবশালী গ্রুপ থেকে নির্বিষ লুটেরা, পেয়েছে আদর-সোহাগ-ভালোবাসা। বাংলাদেশ ব্যাংকের যে কর্মকর্তাই অনিয়মের সহযোগী হতে চাননি, সেই পড়েছেন এই সাবেক গভর্নরের রোষাণলে। ডেপুটি গভর্নরদের চাকরি খাওয়ার হুমকি থেকে শুরু করে কর্মকর্তাদের বদলি- কী করেননি তিনি! এমনকি এসব প্রকাশ্য দানবীয় ঘটনা জনগণের কাছ থেকে আড়াল করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সাংবাদিকদের প্রবেশাধিকার বন্ধ করে দিয়েছিলেন তিনি। 
অর্থ সচিবের চাকরি ছেড়ে ২০২২ সালের ৪ জুলাই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের দায়িত্ব গ্রহণ করেন আব্দুর রউফ তালুকদার। এরপর তার দৃশ্যমান কার্যক্রম দেখলে স্পষ্ট হয়, তিনি মূলত এই দায়িত্বে এসেছিলেন বিভিন্ন ব্যবসায়িক গ্রুপকে ব্যাংক লুটে সহযোগিতা করতে। যে কারণে শেখ হাসিনার সরকার পতনের সাথে সাথে তাকে আশ্রয় নিতে হয়েছে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে। সেখান থেকেই হোয়াটসঅ্যাপে পদত্যাগপত্র পাঠান যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব গ্রহণের অপেক্ষায় থাকা বাংলাদেশের একমাত্র পলাতক গভর্নর। 
ব্যাংক লুটে আব্দুর রউফ তালুকদারের সহযোগিতার অসংখ্য ঘটনা থাকলেও মাত্র পাঁচটি কেস স্টাডি তুল ধরা হয়েছে এই প্রতিবেদনে। 
এস আলম গ্রুপকে বেনামী ঋণ প্রদানে সহযোগিতা: 
শুধু ইসলামী ব্যাংক থেকেই এস আলম গ্রুপের বেনামী ঋণ ৩২ হাজার ১৭২ কোটি টাকা। নাবিল গ্রুপের নামে ৪ হাজার ৫০ কোটি টাকা, সেঞ্চুরি ফুডের নামে ৩ হাজার ৩৮৭ কোটি টাকাসহ বিভিন্ন গ্রুপের নামে এই ঋণ নিয়েছে গ্রুপটি। এসব বেনামী ঋণ নিয়েছে নিজের প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারি কিংবা ড্রাইভারের নামে কাগুজে প্রতিষ্ঠান তৈরি করে। 
নীতিমালা অনুযায়ী, কোন বড় ঋণ প্রস্তাব একক গ্রাহকসীমা অতিক্রম করলে বাংলাদেশ ব্যাংকের অফসাইট সুপারভিশন (ডস) বিভাগের লার্জ লোন শাখা থেকে অনুমোদন নিতে হয়। একই সাথে ঋণ প্রস্তাবসহ পর্ষদের বা নির্বাহী কমিটির মিটিং মিনুট্স পাঠাতে হয় একই বিভাগের বিএসএস বা ব্যাংক সুপারভিশন স্পেশালিস্ট শাখায়। নাবিল গ্রুপের ঋণের প্রস্তাব ডসে আসার সাথে সাথে লার্জ লোন শাখার দায়িত্বে থাকা তৎকালীন পরিচালক তৎকালীন ডেপুটি গভর্নরের কাছে ফাইল উপস্থাপন করে অনুমোদন করিয়ে নেন। এই অনুমোদনপত্র দেখিয়ে ইসলামী ব্যাংক নাবিল গ্রুপকে ঋণ দিয়ে দেয়, যদিও বিএসএস শাখারও অনাপত্তি দরকার ছিল। বিএসএস শাখার কাছে ঋণটি সন্দেহজনক মনে হওয়ায় ওই গ্রুপের যাবতীয় তথ্য-উপাত্ত হাজির করতে নির্দেশ দেয় ইসলামী ব্যাংককে। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে এক রাতের মধ্যে ওই শাখার তৎকালীন পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলামকে ডস থেকে সরিয়ে দেন আব্দুর রউফ তালুকদার। তাকে ডেকে এই সাবেক গভর্নর বলেন, ‘ব্যবসায়ীদের এত ডিস্টার্ব করতে যান ক্যানো? বুঝেন না এটা কাদের প্রতিষ্ঠান?’
ডেপুটি গভর্নরের চাকরি খাওয়ার হুমকি: 
আইন লঙ্ঘন করে ব্যাংক খাতের বহুল আলোচিত এস আলম গ্রুপকে দশ হাজার কোটি টাকার ঋণ দিয়েছে জনতা ব্যাংক। পণ্য আমদানির বিপরীতে এ ঋণ সৃষ্টি হলেও তা শোধ করেনি এস আলম। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশেষ অনুমোদন নিয়ে বছরের পর বছর মেয়াদ বাড়িয়ে কৌশলে নিয়মিত দেখিয়েছে। নতুন করে এই ঋণের মেয়াদ বাড়ানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন সদ্য পদত্যাগ করা বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। এই প্রক্রিয়া আটকে দিলে সাবেক ডেপুটি গভর্নর খুরশিদ আলমকে চাকরিচ্যুত করার হুমকি দেন রউফ তালুকদার। 
চলতি বছরের ৩০ জুন এস আলম গ্রুপের এসব বেআইনী ঋণ নবায়ন ও পুনঃতফসিলের আবেদন করে বাংলাদেশ ব্যাংককে চিঠি দিয়েছিল জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল জব্বার। এই চিঠির প্রেক্ষিতে ঋণ পুনঃতফসিল ও নবায়ন করে দেওয়ার জন্য ডেপুটি গভর্নর খুরশিদ আলমকে নির্দেশ দেন রউফ তালুকদার। কিন্তু ওই নির্দেশ পরিপালন ব্যাংকিং আইন ও বিধিমালার স্পষ্ট লঙ্ঘন হওয়ায় গভর্নরের কাছে তিন বার নেতিবাচক প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন ওই সাবেক ডেপুটি গভর্নর। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে এসএমটি (সিনিয়র ম্যানেজমেন্ট টিম) মিটিংয়ে রউফ তালুকদার প্রকাশ্যে খুরশিদ আলমকে লক্ষ্য করে বলেন, ‘আপনি কি চাকরি করবেন? এদের (এস আলম গ্রুপ) আটকাচ্ছেন কেন? আমি যেকোন সময় আপনাকে বাদ দিতে পারি। এত মাতব্বরি দেখান কেন?’ গভর্নরের এই হুমকির পরেও সরকার পতনের আগের দিন পর্যন্ত এই ফাইল আটকে রেখেছিলেন তৎকালীন ডেপুটি গভর্নর খুরশিদ আলম। ডিপার্টমেন্ট অব অফসাইট সুপারভিশনের দাপ্তরিক নোটে দেখা গেছে, তাঁর দপ্তরে ৩০ জুলাই এস আলমের ঋণ নবায়ন ও পুনঃতফসিলের প্রস্তাব আসলেও ৪ জুলাই পর্যন্ত আটকে রাখেন। এরপর অনুমোদনের প্রস্তাব বাতিল করেন খুরশিদ আলম। ফলে জনতা ব্যাংকে থাকা এস আলম গ্রুপের পুরো ঋণই খেলাপিতে পরিণত হবে।
ব্যাংকের ডিএমডির পরামর্শে ডেপুটি গভর্নরকে কাজ করার নির্দেশ: 
খুরশিদ আলম ডেপুটি গভর্নরের দায়িত্ব নিয়েছেন মাত্র এক মাস হলো। তখন গভর্নর রউফ তালুকদার তাকে ডেকে পাঠালে গিয়ে দেখেন সেখানে ইসলামী ব্যাংকের ডিএমডি আকিজ উদ্দিন বসা। আকিজ উদ্দিন ব্যাংকের ডিএমডি পদে থাকলেও এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম মাসুদের পিএস হিসেবেও কাজ করেন। তিনি এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন স্যোশাল ইসলামী ব্যাংকের প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ নিয়মিত দেখানোর একটি আবেদন নিয়ে এসেছেন। গভর্নর রউফ তালুকদার তৎকালীন দায়িত্বপ্রাপ্ত ডেপুটি গভর্নর খুরশিদ আলমকে নির্দেশ দেন এটি অনুমোদন দেওয়ার জন্য। এটি অনুমোদনযোগ্য নয় জানালে খুরশিদ আলমকে কড়া ভাষায় নির্দেশ দেন আকিজ সাহেবের সাথে পরামর্শ করে গ্রুপের নিয়ন্ত্রণাধীন ব্যাংকগুলোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে।  
ইসলামী ব্যাংকের রেটিং ম্যানিপুলেশনের নির্দেশ: 
চলতি বছরে ইসলামী ব্যাংকের ক্যামেলস রেটিং প্রান্তিক মানে অর্থাৎ ৪-এ চলে আসে। গত বছর এটা ছিল মোটামুটি ভালো মানে (৩)। বাংলাদেশ ব্যাংক যাতে ইসলামী ব্যাংকের ক্যামেলস রেটিং না কমিয়ে গত বছরের মানে রাখে সেজন্য জুলাইর শেষ দিকে খুরশিদ আলমের কাছে তদবিরে আসেন ইসলামী ব্যাংকের ডিএমডি আকিজ। খুরশিদ আলম তখন তাকে নিয়ে গভর্নরের কাছে গেলে গভর্নর বলেন, ‘দেখেন কি করা যায়। গত বছরের মানে রাখা যায় কি না।’ এই নির্দেশের প্রেক্ষিতে খুরশিদ আলম অধিনস্ত কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেন, কেন ইসলামী ব্যাংকের ক্যামেলস রেটিং ৩ এ নামানো যাবে না সে বিষয়ে পয়েন্ট আকারে লিখে আনার জন্য। এর মধ্যে সরকার পতনের পর রউফ তালুকদার পালিয়ে গেলে ইসলামী ব্যাংকের ক্যামেলস রেটিং চারেই থেকে যায়। 
নির্বিষ সাপেও সমীহ তালুকদারের:
শুধু প্রভাবশালী বড় গ্রুপ নয়, প্রভাব-প্রতিপত্তিহীন ব্যাংক লুটেরাদেরও সমীহ করতেন রউফ তালুকদার। প্রমাণিত অনিয়মের কারণে সাউথইস্ট ব্যাংকের চেয়ারম্যান আলমগীর কবির এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক নুরুদ্দিন মো. ছাদেক হোসাইনকে শাস্তির আওতায় আনতে চাইলে সাবেক ডেপুটি গভর্নর খুরশিদ আলমকে বাধা দেন তিনি। 
বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্ত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, শেয়ার কেনার জন্য চেয়ারম্যানের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ইউনাইটেড সিকিউরিটিজ কোম্পানিকে ১০০ কোটি টাকা ঋণ দিতে চেয়েছিল সাউথইস্ট ব্যাংক। ঋণ প্রস্তাবটি ব্যাংকের পর্ষদ সভায় উপস্থাপন ও পাসের প্রক্রিয়া অস্বচ্ছ হওয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংক আটকে দেয় এবং তদন্ত করে। তদন্তে চেয়ারম্যান ও এমডির অনিয়ম বের হলে শাস্তির উদ্যোগ নেন তৎকালীন ডেপুটি গভর্নর মো. খুরশিদ আলম। কিন্তু এই প্রক্রিয়া আটকে দেন রউফ তালুকদার। এমনকি সিনিয়র ম্যানেজমেন্ট টিমের (এমটিএস) সভায় সাউথইস্টের ইস্যু নিয়ে না আগানোর নির্দেশ দেন এই সাবেক গভর্নর। সাউথইস্ট ব্যাংকের এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বাংলাদেশ ব্যাংক যাতে সাউথইস্ট ব্যাংকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয় সেজন্য ব্যাংকটির গুলশান শাখা থেকে ১০ কোটি টাকার বেনামি ঋণ সৃষ্টি করে সাবেক গভর্নর রউফ তালুকদারকে দিয়েছে। এই টাকা ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক নুরুদ্দিন মো. ছাদেক নিজ হাতে পৌঁছে দেন গভর্নরের কাছে। 
এই বিষয়ে সাউথইস্ট এমডি নুরুদ্দিন মো. ছাদেকের বক্তব্য জানতে ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। ফোনে ক্ষুদে বার্তা পাঠানো হলেও উত্তর দেননি। গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার পলাতক থাকায় তাঁর বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। ###
 

Side banner