মাত্র ২৮ কোটি টাকা। সর্ব-সাধারণের কাছে অঙ্কটা একটু বড়ই, কিন্তু বাংলাদেশের বৃহত্তম শিল্পগোষ্ঠী বসুন্ধরার জন্য টাকার এই পরিমাণটা নিতান্তই-নগণ্য। এর চাইতে কাড়ি-কাড়ি টাকা ‘দান-সদকাতেই’ খরচ করেন বসুন্ধরার চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান ও তাঁর বহুল আলোচিত পুত্র সায়েম সোবহান আনভীরসহ তাঁদের পরিবারের সদস্যরা। সাংবাদিক সংগঠন থেকে শুরু করে বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনে বসুন্ধরা গ্রুপের ‘ঘোষিত-অঘোষিত’ অনুদান কখনও-কখনও প্রশংসিত হয়েছে। আবার তাঁদের ‘অনুদানকে’ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হিসেবেও সন্দেহ আছে কারও-কারও মনে। সংশয়-সন্দেহকে ছাপিয়ে অনুদানের ক্ষেত্রে বসুন্ধরা গ্রুপের সমর্থকের সংখ্যাই বেশি হতে পারে, তা-ও আবার তালিকায় সমাজের কবি-সাহিত্যিক-সাংবাদিকের সংখ্যাই অনেক। অথচ প্রভাবশালী এই গ্রুপটিই কী-না একটি ব্যাংকের মাত্র ২৮ কোটি টাকা ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে গড়িমসি করছে। টানা ১২টি কিস্তি বাকি রেখেছে গ্রুপটি।
ব্যাংক আইন অনুযায়ী যে কোনো ব্যাংকের কিস্তি ৬ মাস বাকি থাকলেই ঋণগ্রহীতা ব্যাক্তি-প্রতিষ্ঠানের নাম উঠে যায় খেলাপির তালিকায়। কিন্তু বসুন্ধরার নাম খেলাপির তালিকায় স্থান দেওয়ার মতো ‘দুঃসাহস’ দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংকটি। বরং ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা থেকে শুরু করে আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংকের উর্ধ্বতন কমকর্তাদের ধারণা- এতো ছোট অঙ্কের ঋণের কিস্তি যে বকেয়া পড়ে আছে, তা হয়তো বসুন্ধরার মালিকপক্ষের আগে জানাই ছিল না। আর এ কারণেই বসুন্ধরার জন্য আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অপেক্ষা করতেও সমস্যা নেই ব্যাংক-সংশ্লিষ্টদের। ইতোমধ্যে বসুন্ধরা গ্রপের পক্ষ থেকে এই সময়ের মধ্যেই বারো কিস্তির পুরো টাকা পরিশোধের আশ্বাসও পেয়েছে বেসিক ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।
আর্থিক খাতে অপ্রকাশ্যে থাকা বসুন্ধরার সমালোচকরা অবশ্য ভিন্ন কথা বলেছেন। তাঁদের তথ্যানুযায়ী, শুধু বেসিক ব্যাংকেই নয়, কিস্তি পরিশোধের ক্ষেত্রে কোনো-কোনো সময় বসুন্ধরা গ্রুপ একটু কৃপণতাই দেখিয়ে থাকেন। এর আগে ন্যাশনাল ব্যাংকে ২৮টি কিস্তি বকেয়া রেখেও খেলাপি হয়নি বসুন্ধরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এস আলম গ্রুপের পর বর্তমানে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ঋণগ্রহীতা গ্রুপ বসুন্ধরা। ২৭টি ব্যাংক থেকে গ্রুপটি ঋণ নিয়েছে মোট ৪২ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে সরাসরি ঋণ বা ফান্ডেড লোন ১৮ হাজার কোটি টাকার বেশি। বাকিটা বিভিন্ন ধরনের ঋণসুবিধা। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে বসুন্ধরার সরাসরি ঋণ ছিল ১৪ হাজার ৬৩৪ কোটি টাকা। দুই বছরের মধ্যে ঋণ বেড়েছে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, এসব ঋণের বিপরীতে গ্রুপটি ব্যাংকগুলোকে যেসব জামানত দিয়েছে সেসবের মূল্য ৮ হাজার ১৫১ কোটি টাকা। সেক্ষেত্রে জামানত ও ঋণের হার ৫৫ শতাংশ। অর্থাৎ জামানতের দ্বিগুণ ঋণ নিয়েছে গ্রুপটি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবসায়িক স্বাস্থ্য এখন অনেকটা খারাপের দিকে। বিপুল ঋণ থাকলেও এই গ্রুপের ইক্যুয়িটির পরিমাণ ২ হাজার ১১৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ কোম্পানির সকল দায়দেনা শোধ করার পর এই পরিমাণ মূল্যের সম্পদ বসুন্ধরার হাতে থাকবে। গ্রুপটির ইক্যুয়িটির বিপরীতে দায়ের পরিমাণ (ডেবট-ইক্যুয়িটি রেশিও) প্রায় ৭শ শতাংশ, যা মারাত্মক ব্যবসায়িক ঝুঁকি নির্দেশ করে। নিয়ম অনুযায়ী, এই হার একশ শতাংশের নিচে থাকলে অর্থায়ন ঝুঁকিমুক্ত থাকে।
তথ্যানুযায়ী, বিগত সরকারের প্রভাবশালী গোষ্ঠীর সহায়তায় এবং সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে ন্যাশনাল ব্যাংকে থাকা ৩ হাজার ৮৫৯ কোটি টাকার ঋণ পুনঃতফসিল করিয়ে নিয়েছিল বসুন্ধরা। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের মাত্র ৪ দিন আগে এই দৃষ্টান্ত সৃষ্টিকারী সুবিধা নিয়েছে গ্রুপটি, যেখানে আগামী দুই বছর তাঁদেরকে কোনও ঋণ পরিশোধ করতে হবে না।
গত ৫ সেপ্টেম্বর পুলিশের অপরাধ তদন্ত সংস্থা সিআইডি এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, বসুন্ধরা গ্রুপের বিরুদ্ধে দেড় লাখ কোটি টাকা মূল্যের জমি দখল এবং অর্থপাচারের অভিযোগ পাওয়ায় এর কর্ণধার আহমেদ আকবর সোবহান ও তার ছেলে সায়েম সোবহান আনভীরসহ স্বার্থ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করছে সংস্থাটি। এতে বসুন্ধরা গ্রুপের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রতারণা, জাল জালিয়াতি, শুল্ক ও ভ্যাট ফাঁকি, আন্ডার ইনভয়েসিং ও ওভার ইনভয়েসিং করে হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগ পাওয়ার কথা জানানো হয়।
এর আগে গত ২২ আগস্ট বসুন্ধরা গ্রুপের মালিকদের কর ফাঁকি খুঁজতে বিশেষ অনুসন্ধান কার্যক্রম শুরু করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেল (সিআইসি)। একইসঙ্গে তাদের ব্যাংক হিসাব তলব করেছে।
কোন ব্যাংকে কত ঋণ : দেশের মোট ২৭টি তফসিলি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে বসুন্ধরা গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। এই গ্রুপে অর্থায়নকারী ব্যাংকগুলোর মধ্যে রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী, সোনালী, জনতা, রূপালী, বিডিবিএল ও বেসিক ব্যাংক। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে রয়েছে ন্যাশনাল, ব্যাংক এশিয়া, মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট, সাউথ বাংলা, ঢাকা ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি, পূবালী, ইসলামী ব্যাংক, সোস্যাল ইসলামী, ইউনাইটেড কমার্শিয়ালসহ ১৯টি ব্যাংক। এছাড়া আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ ইনফ্রাস্ট্রাকচার ফাইন্যান্স ফান্ডের বিনিয়োগ রয়েছে। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঋণ রয়েছে অগ্রণী ব্যাংক ও ন্যাশনাল ব্যাংকে।
গ্রুপটির বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অগ্রণী ব্যাংকের অর্থায়নের পরিমাণ ৬ হাজার ৩৭৬ কোটি টাকা, যা ব্যাংকটির মোট বিতরণকৃত ঋণের প্রায় ৯ শতাংশ। পাশাপাশি ন্যাশনাল ব্যাংক ঋণ দিয়েছে ৩ হাজার ৮৫৯ কোটি টাকা, যা ব্যাংকটির মোট বিতরণ সীমার ৮ গুণ বেশি। বসুন্ধরা গ্রুপের মোট ১১টি প্রতিষ্ঠানের নামে এই ঋণ বিতরণ হয়েছে, যেগুলোর মধ্যে ৭টি প্রতিষ্ঠানের ২৮টি কিস্তি বাকি রয়েছে। এরপরও বসুন্ধরাকে খেলাপি করেনি ন্যাশনাল ব্যাংক। উল্টো আগামী দুই বছর কিস্তি পরিশোধ থেকে অব্যাহতি দিয়ে ঋণ পুনঃতফসিল করে দেওয়া হয়েছে।
বসুন্ধরার ঋণ নিয়ে ন্যাশনাল ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ আকতার উদ্দিন আহমেদ নতুন সংবাদকে বলেন, বসুন্ধরার ঋণের অর্থ আমরা ফেরত পাবো। কারণ তাদের পর্যাপ্ত জামানত আমাদের কাছে রাখা আছে।
কিস্তি আদায়ের বিষয়ে বেসিক ব্যাংকের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা নতুন সংবাদকে জানান, ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে কিস্তি পরিশোধ না করলে ঋণটি খেলাপি করা হবে। তবে বসুন্ধরা গ্রুপ তাদেরকে জানিয়েছে, চলতি সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যেই তারা কিস্তি পরিশোধ করবে।
গভর্নরের দেখা চান আনভীর : এদিকে, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুরের সাক্ষাৎ পেতে চেষ্টা চালাচ্ছেন বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সায়েম সোবহান আনভীর। এজন্য গত ১২ সেপ্টেম্বর গভর্নরকে ফোন করেছেন তিনি। গভর্নরের ঘনিষ্ট একটি সূত্র এমন দাবিই করেছেন নতুন সংবাদের কাছে। অনেকের ধারনা, বসুন্ধরা গ্রুপের মালিকপক্ষের ব্যাংক হিসাব যাতে জব্দ করা না হয় এবং বকেয়া ঋণগুলো যাতে খেলাপি না করা হয়, হয়তোবা সে জন্যই গভর্নরের সাক্ষাৎ চাচ্ছেন তিনি। তবে বসুন্ধরার অর্থপাচারের অভিযোগের বিষয়ে সিআইডিতে তদন্ত চলমান থাকায় এই গ্রুপটির কর্নধারদের আপাতত সাক্ষাৎ দিতে আগ্রহী নন গভর্নর। ###
আপনার মতামত লিখুন :